‘আপনারা হলেন উচ্চ শিক্ষিত, আপনারাই হতে পারেন সমাজের উদাহরণ। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।’ বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া এক দম্পতির উদ্দেশে এমন মন্তব্য করেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতি।
Advertisement
আদালত বলেন, মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তানরা মিলন চায়, তারা কখনো বিচ্ছেদ কামনা করে না। এমনি দুই সন্তান ধ্রুব এবং লুব্ধও তার মা-বাবার মিলন চায়। তারা হলো সমাজের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
প্রত্যেক ডিভোর্সে সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা। তাদের সবাইর অনুভূতি একই রকম বলে মন্তব্য করেন আদালত।
বুধবার এ সংক্রান্ত মামলার শুনানির সময় হাইকোর্ট বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।
Advertisement
জানা গেছে, শিশু দু’টির মা কামরুন্নাহার মল্লিকা রাজশাহীর মেয়ে, বাবা মেহেদী হাসান মাগুরার ছেলে। মল্লিকা ঢাকায় গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে এবং মেহেদী ঢাকা কলেজে পড়েছেন। পড়ালেখা করা অবস্থায় দু’জনের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম, অতঃপর দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে।
ঘর আলোকিত করে আসে দু’টি ফুটফুটে সন্তান। মল্লিকা ও মেহেদী দম্পতি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। ভালোই চলছিল সংসার জীবন। একপর্যায়ে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। পরিণতিতে ২০১৭ সালের ১২ মে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর মাগুরাতে বড় হচ্ছিল শিশু দু’টি। এই এক বছর মা ও সন্তানের মধ্যে দেখা হয়নি।
মা কামরুন্নাহার মল্লিকার অভিযোগ, সব রকম চেষ্টা করেও শিশু দু’টির ফুফুর কারণে তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেয়ার জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন তিনি।
কামরুন্নাহার মল্লিকা তার দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে গত ২৯ মে আদালত শিশু দু’টিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দু’টির বাবাকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়।
Advertisement
২৫ জুন তারা আদালতে হাজির হলে দীর্ঘদিন পর মুখোমুখি হওয়ায় সন্তান ও মায়ের কান্নায় এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মা দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। এ সময় ছেলেরাও দীর্ঘদিন পর মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। বড় ছেলে তখন হাত বাড়িয়ে বাবাকেও ডাকতে থাকে।
ছেলে বলতে থাকে, বাবা, তুমি এসো। তুমি আমার কাছে এসো। আম্মুকে সরি বলো। এসময় বাবাও এগিয়ে এলে আদালতের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য দেখে বিচারক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবার চোখে পানি চলে আসে। দীর্ঘ এক বছর পর বাবা-মাকে একসঙ্গে পেয়ে ছেলেদের কান্না সবার বিবেককে নাড়া দেয়।
এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক আবার ওই শিশুদের ডেকে নেন। সঙ্গে মাকেও কাছে ডাকেন। আদালত বলেন, এ দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না? আপনারা কি সন্তানের জন্যও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না? সামনে তাকিয়ে দেখেন, আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সবার চোখেই পানি চলে আসছে।
এ সময় আদালতে উভয়পক্ষের আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি চিন্তা করে বাবা-মাকে মেনে নেয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এ সেরকম একটি আদেশ দেয়ার দাবি জানান।
পরে আদালত দুই শিশু এবং তাদের বাবা-মা, নানি ও ফুফুকে আদালতের এজলাসের কাছে ডেকে নেন। একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য শোনেন। পরে বিস্তারিত জানতে চেম্বারে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবা ও মাকে।
আদালত আদেশে বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে পিতা শিশুদের দেখাশোনা করার সুযোগ পাবেন। আগামী ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন।
আজ (৪ জুলাই) আদালতে মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তাপস কান্তি বল। আর মল্লিকার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস ও এ কে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।
আদালত জানতে চান পরিস্থিতির কি কোনো উন্নতি হয়েছে?
তখন তাপস কান্তি বলেন, ‘হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটির তার বাবাকে মায়ের বাসায় রাতে থেকে যাওয়ার আবদার জানালে বাবা রাজি হলেও মা রাজি হননি। রাত ১টায় বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক সমস্যার কারণে ব্যাংকে অভিযোগ দেয়ার কারণে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে বাবার চাকরি চলে যায়।’
পারিবারিক এই বিষয়টি স্মরণ করে দিয়ে এই সময় আদালত বলেন, ‘এই ঘটনা মিডিয়ায় কীভাবে গিয়েছে দেখেছেন? জনমত সেটাকে কীভাবে দেখেছেন। এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তখন তাপস কান্তি বলেন, ‘বাবা শিশুদের কাছে সারেন্ডার করেছে। বাচ্চারা যেভোবে চাইবেন বাবা সেভাবে করবেন।’
আদালত বলেন, ‘এটাকে কি পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?’
তাপস কান্তি বলেন, ‘কিছু তো উন্নতি হয়েছে।’
পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। সুতরাং দুইজনের মধ্যেই সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য আরও সময় লাগবে।’
তখন আদালত বলেন, ‘ঠিক। এটাতো রাতারাতি উন্নতি হবে না।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘বাচ্চা দুটি ইতোমধ্যে ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চারা খুশি প্রতিদিন মা স্কুলে আনা-নেয়া করছেন।’
এসময় আদালত বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হয় না।’
তখন রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘এই ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর যেখানে গিয়েছি সেখানে বলেছে- তোমরা পুণ্যের কাজ করেছো। আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। কোর্ট সমঝোতার জন্য সময় দিয়েছে। এটা সর্বমহলে বার্তা দিয়েছে। শিশুদের কল্যাণ বিবেচনায় পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে উভয় পক্ষকে মনে রাখতে হবে, আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্য কিছু ভেবে থাকেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে আদালতের হাত খাটো না। বাচ্চাদের মঙ্গল চিন্তা করে আদালত যেকোনো আদেশ দিতে পারেন।’
তখন আদালত বলেন, ‘শুধু এ বিষয় না, প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সবাইর অনুভূতি একই রকম। হয়তো এ দুটি বাচ্চা আজকে আমাদের সঙ্গে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। সারা দেশের বিচ্ছিন্ন পরিবারের সব বাচ্চারই অনুভূতি এক, তারা সেটা বলতে পারে না। বাবা-মা শুনলেও অন্যরা বাচ্চাদের অনুভূতি কানে নিচ্ছে না।’
এ সময় তাপস কান্তি বলেন, বাচ্চারা যদি চায় বাবাকে যেন বাসায় থাকায় অনুমতি দেয়া হয়। প্রয়োজনে ড্রয়িং রুমে থাকবে।
তখন আদালত বলেন, অপেক্ষা করুন, সমঝোতা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর আদালত শিশু ও বাবা-মা দুজনের কথা শোনেন।
আদালত শিশুদের উদ্দেশ্য বলেন, তোমরা কে কোন দল সমর্থন করো। জবাবে বড় ছেলেটি বলে- ব্রাজিল। ছোটটি বলে- আমি আর্জেন্টিনা।
বাবা-মাকে উদ্দেশ্যে করে আদালত বলেন, আপনারা দুইজনই শিক্ষিত সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।
তখন তাপস কান্তি বলেন, ‘মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরছে। বাবারও ইচ্ছা শিশুদের নিয়ে ঘুরতে।’
আদালত বলেন, ‘বাবাও ঘুরতে পারবেন।’
এরপর আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ঠিক করেন। এসময় আদালত বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতির জন্য দুই পক্ষই সময় চেয়েছেন। সময় দেয়া হলো।
আদেশের পরে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আজকে আদালতে বাবা-মাসহ বাচ্চা দুটি উপস্থিত ছিলেন। আদালত আমাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন ওনাদের দুজনের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতদূর? আমরা বলেছি যে, আর একটু সময় যদি আপনারা দেন। তাহলে আমি সন্তানের মায়ের পক্ষ থেকে বলেছি, মা ওপেন আছেন। বাবার পক্ষ থেকে তার আইনজীবীও বলেছেন, সন্তানের ভালোর জন্য তিনি সব মেনে নেবেন।
এফএইচ/এমবিআর/আরআইপি