বর্তমান সময়ে পরিবেশগত ভাবনা বর্তমান বিশ্বের এক অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন, ভয়াবহ পরিবেশগত দূষণ ও বিপর্যয় নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ আজ বেশ উদ্বিগ্ন। কেননা পরিবেশগত সুরক্ষা ও বিপর্যয় রোধ করা না গেলে মানব জীবনে নেমে আসবে মহাবিপর্যয়।
Advertisement
পরিবেশগত এই সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে এই সমস্যা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আজ বিশ্ব রাজনীতিরও অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা। প্রাণীজগত, উদ্ভিদজগত এবং জড়জগতের সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে পরিবেশকে কেন্দ্র করে। এই পরিবেশকে উপেক্ষা করে মানবজাতি পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারবে না। তাই পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে জাতিসংঘ, জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
এই বিশ্ব পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টিতে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্র সুইডেন। প্রকৃতি ও পরিবেশগত দূষণ, অবক্ষয় ও বিপর্যয় সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৯৬৮ সালের মে মাসের ২০ তারিখে জাতিসংঘের অর্থনীতির ও সামাজিক পরিষদকে চিঠি পাঠায় তৎকালীন সুইডেন সরকার। এই চিঠির প্রেক্ষিতে বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরবর্তী বছরে জাতিসংঘের সদস্য বাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে সমাধান খুঁজতে যেয়ে বিস্তৃত আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পরিবেশগত আন্তর্জাতিক সম্মেলন হিসেবে স্বীকৃত।
Advertisement
এরপর জাতিসংঘ ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিনটিকে অর্থাৎ ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সাল থেকে বিষয়টি সারা বিশ্বে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায়। এই সরকারের পরিবেশগত ভাবনা কার্যক্রম ও পরিকল্পনার কিছু বিষয় উল্লেখ করার মতো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সম্প্রতি ২০১৮ সালের ১৪ মে বাংলাদেশ সরকার তার মন্ত্রিসভায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে। নতুন নামকরণ করা হয়, ‘পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়’ ((Ministry of Environment, Forest and Climate Change). বাংলাদেশ সরকারের স্বতন্ত্র এই মন্ত্রণালয়টি আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়ার কারণে এই মন্ত্রণালয়ের আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সুবিধা অনেক বেশি।
এই মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ হচ্ছে- পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষায়ন-বনায়ন, পরিবেশগত অবক্ষয় প্রতিরোধ ও দূষণ নিয়ন্ত্রনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করা। তাছাড়া বন ও পরিবেশের উপাদান সমূহের মধ্যে সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাও এই মন্ত্রণালয়ের অন্যতম কাজ।
এই মন্ত্রণালয়ের রয়েছে দুটি অধিদপ্তর - পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তর তার ভিশনে বলছে, ২০২১ সালের মধ্যে সুস্থ, সুন্দর ও দূষণমুক্ত এবটি মডেল বাংলাদেশ বির্নিমান করা। আর মিশন হচ্ছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
Advertisement
আর এ লক্ষ্যে অধিদপ্তর পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশ সংক্রান্ত অনেক নিয়ম ও বিধিবিধানের সঠিক প্রয়োগ ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করে থাকে। এছাড়া এই অধিদপ্তর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘গ্রিন গ্রোথকে’ উৎসাহিত করে থাকে।
অন্যদিকে বন অধিদপ্তরের ভিশনে রয়েছে, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটিয়ে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে জীবনযাত্রা প্রণালীর আর্থ সামাজিক উন্নয়ন। বন অধিদপ্তর তার মিশনে সরাসরি জনসমৃক্ততার মধ্যে দিয়ে বনজ সম্পদের সম্প্রসারণ, বিভিন্ন প্রকার জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ,দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
বর্তমান সরকার ইতিমধ্যে পরিবেশ দূষণরোধে বিশ্বব্যাংকের সাথে সৃজনশীল, পরিবেশবান্ধব টেশসই প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ’ শিরোনামের প্রকল্পের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক ০.৭৫ শতাংশ সাভিস চার্জে বাংলাদেশকে ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করবে বাকী ১৬৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে পিকে এস এফ। চলতি অর্থবছর শুরু হয়ে এই প্রকল্পের কাজ চলবে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের সহায়ক ভূমিকা অর্জিত হবে। এই জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে অনেকটা সক্ষম হবে। পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি ও কর্ম পরিকল্পনায় বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রসংশিত হয়েছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশগত ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সূদুরপ্রসারি পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলস্বরূপ সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “চ্যাম্পিয়ন অফ দ্যা আর্থ” পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা পলিসি লিডারশীপ ক্যাটাগরিতে এই পুরুস্কার পান। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে পরিবেশের নোবেল খ্যাত পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক এই পুরস্কার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তিনি গ্রহণ করেন।
আমাদের দেশের স্কুল পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। তবে পরিবেশ বিষয়ক আলোচনার বিস্তারিত পাঠ প্রদান করা হয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সাবজেক্টে। যেমন : ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিদ্যা , সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে পরিবেশগত সমস্যা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।
আর দর্শন বিষয়ে পরিবেশ সম্পর্কিত নৈতিক দিক নির্দেশনা ও করণীয় নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ পরিবেশগত একটা সামগ্রিক মূল্যায়ন আমরা পরিবেশ নীতিবিদ্যা বা পরিবেশ দর্শনের আলোচনায় দেখতে পাই। সরকার, রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বিত চিন্তা-চেতনা ও পরামর্শ দ্বারা আমাদের দেশের পরিবেশগত সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা যাবে মনে করি ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
gmtariq@yahoo.com
এইচআর/আরআইপি