রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেই সুযোগ মেলে গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরির। কাজ শুরু হয় পল্লী নারীদের সঙ্গে। তবে চাকরি পাওয়া সুখের হলেও পল্লী নারীদের মাঝে কাজ করতে গিয়ে চোখ থেমে যায় তাদের অসহায় জীবনের গল্প দেখে। দেখেন সমাজের অসহায় আর পিছিয়ে পড়া নারীদেরকে ঋণ দিলেও কিছুদিন না যেতেই খরচ করে ফেলতেন তারা। এরপর আবারও পূর্বের অবস্থা। একই সমাজে অবস্থান করা নারীদের এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন উদ্যোক্তা হওয়ার। এরই মধ্যে রাজশাহীর প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে অর্ধশতাধিক অসহায় নারীকে নিয়ে পথ চলছেন। বলছিলাম রাজশাহীর নারী উদ্যোক্তা রিজিয়া রহমানের কথা।
Advertisement
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ এই দশ বছর গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি করার পর ছেড়ে দেন। এরপর ২০১০ সালের দিকে রাজশাহীতেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে নিত্য ফ্যাশন নামের প্রথম গার্মেন্টেস প্রতিষ্ঠা করেন রিজিয়া। যেখানে কাজ দেন অসহায় নারীদের।
রিজিয়ার গার্মেন্টস এ কাজ করছেন এমন একজন রোখসানা। রোখসানা বলছিলেন, ‘ছোট ছোট দুই মেয়েকে ফেলে একমাত্র উপার্জনক্ষম অটোরিকশাচালক স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর দিশেহারা হয়ে পড়ি। ৫ বছর আগের ওই সময়টার কথা মনে করতেই ভয় হয়। কারণ তেমন একটা শিক্ষা লাভ না করতে পারায় কোন চাকরি জুটেনি। দিন নেই রাত নেই দুঃখ কষ্টে চলতে থাকে কয়েক মাস। পরবর্তীতে ঠাঁই হয় নিত্য ফ্যাশন নামের স্থানীয় একটি গার্মেন্টে। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ানো। আমাকে কাজ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রিজিয়া আপা।
শুধু রোখসানা নয়, স্বামী পরিত্যক্তা রাবেয়া, বিধবা হেনা, অসহায় মেয়ে শ্যামলীসহ আরও প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ জন অসহায় নারীকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন সেই নারী।
Advertisement
রিজিয়া জানাচ্ছিলেন, যে প্রতিষ্ঠানে আজ প্রায় শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে শুরুটা এতটা জাকজমক ছিল না। পুঁজি সংকটে মাত্র ৩টি মেশিন ও ২০ হাজার টাকার গার্মেন্ট কাপড় নিয়ে কাজ করতে শুরু করতে হয় তাকে। ঘরের মধ্যে ছোট একটা রুমে কাজ শুরু করেছেন।
রিজিয়ার জন্ম বনলতা সেনের শহর নাটোরে। জেলার লালপুর থানার রামানন্দপুর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ৪ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে শিক্ষিকা মা এবং মুক্তিযোদ্ধা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পড়ালেখা শুরু করেছিলেন গ্রামের স্কুল থেকেই।
বিলমাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসেরর পর এলাকার সাধনা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। এইচএসসি শেষে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেন।
তবে স্নাতকোত্তর শেষ না করেই গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি নেন তিনি। প্রায় দশ বছর পর ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে একই বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেন তিনি। বর্তমানে তিন সন্তানের জননী তিনি। তবে তিন বছর হলো তিন সন্তানকে রেখে স্বামী গত হয়ে গেছেন।
Advertisement
অসহায়দের কাজ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রিজিয়া বলেন, প্রতিবেশী হিসেবে ২০ থেকে ২৫ জন মেয়েকে মাসে ৫শ’ বা হাজার খানেক করে টাকা দিলাম। এতে কিছুটা হলেও প্রতিবেশীর উপকার হলো। তবে বাস্তবিক পক্ষে আমি ওই মানুষগুলোর ক্ষতি করলাম এবং অলস করে দিলাম। তাদের উপকারও করবো নিজের জন্য বা সমাজের অসহায় অন্য আর পাঁচটা মানুষের জন্য কিছু করতে পারবো এই চিন্তা থেকেই শুরু করেছি। তাদেরকে নিয়েই আমার পরিবার।
মাস্টার্স শেষের দুই বছর পর উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজ বাড়িতেই তিনটি মেশিন নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। তৈরি করতে থাকেন ছেলেদের যাবতীয় পোশাকসামগ্রী। বর্তমানে দেশের গন্ডি পেরিয়ে রিজিয়ার গার্মেন্টে তৈরি পোশাক বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।
কাজের মান ভালো হওয়ায় আরব আমিরাত, কুয়েত, ইন্ডিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পোশাক রফতানি অব্যাহত আছে বলে জানান রিজিয়া।
বর্তমানে রাজশাহীর অন্যতম নারী উদ্যোক্তাদের উচ্চ আসনে থাকলেও নতুন নারী উদ্যোক্তা হওয়ার বহুবিধ সমস্যার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নারীদের সামাজিক অবস্থান থেকে বাবা, শ্বশুর বাড়ি থেকে, একটু বয়স্ক হলেই সন্তানদের থেকে প্রতিকূলতা আছেই। তার ওপর ব্যাংকগুলো নতুন কাউকে ঋণ দিতে চায় না। অন্যদিকে সুদের হার অনেক বেশি। শিল্পখাতে যারা ব্যবসা করবে তাদের সুদের হারটা যদি একটু কম থাকতো তাহলে হয়তো এরা এগিয়ে যেতে পারতো।
তবে ব্যাংকগুলোকে দোষ দিতে চাননি তিনি। বলেন, তাদের নীতিমালায় জামানত দেয়ার শর্ত আছে সেই শর্ত পূরণ করতে কয়জন পারবে? কারও স্বামী বা বাবার জমি থাকতে পারে। কিন্তু মাস্টার্স পাস করেও সার্টিফিকেট ছাড়াতো কোনো মেয়ে বা ছেলের কিছুই নেই।
এমএএস/এমএস