বিশেষ প্রতিবেদন

ধরা হয় কিন্তু সাজা হয় না

বাংলাদেশে প্রচলিত মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও কারোর দখলে বা অবস্থানে মাদক পাওয়া না গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। যারা এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা গডফাদার তারা মাদক পরিবহন বা নিজেদের কাছে রাখেন না৷ ফলে তারা মূল অপরাধী হলেও পার পেয়ে যান৷

Advertisement

তবে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। গত ২০ জুন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ অনুযায়ী মাদক অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে বিদ্যমান আইনে কোনো ব্যক্তির দখলে/কর্তৃত্বে/অধিকারে মাদকদ্রব্য পাওয়া না গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ কম। তাই মাদক ব্যবসায় জড়িত মাস্টার মাইন্ডরা সহজেই পার পেয়ে যায়।’

আরও পড়ুন >> মাদক নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধন হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

তিনি বলেন, ‘মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক ও গডফাদারসহ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হচ্ছে। সংশোধিত আইনে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক ও মাদকের গডফাদারসহ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হবে। এছাড়া এ আইনে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকেও আইনের আওতায় আনার জন্য মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ তদন্তে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে।’

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯০ এর অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক আদালত গঠনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মাদক অপরাধীদের তাৎক্ষণিক সাজা দেয়া হচ্ছে। মাদক অপরাধ-সংক্রান্ত মামলার বিচার কার্যক্রম আলাদা কোনো আদালতের মাধ্যমে পরিচালনার বিষয়টি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখছে।’

তিনি জানান, গত ১৮ মে ২০১৮ হতে এখন পর্যন্ত চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং এগুলো পরিবহনের বাহন উদ্ধার ও জব্দ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মাদকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট মোট ১৫ হাজার ৩৩৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মোট ২০ হাজার ৭৬৭ জনকে গ্রেফতার করে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, যারা খুচরা বিক্রি করেন বা সেবন করেন তারাই ধরা পড়েন৷ আর আইনে মাদক সেবনকারী, বিক্রেতা, পাচারকারী ও নিয়ন্ত্রক আলাদাভাবে নেই৷ ফলে যার কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়, তাকেই মামলায় আসামি করা হয়৷

আরও পড়ুন >> রাঘব বোয়ালরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে

Advertisement

আইনের এ দুর্বলতার কারণে মাদক মামলায় শাস্তিও হয় কম৷ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এ আইনে ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট মামলা হয়েছে এক লাখেরও বেশি৷ মামলগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা৷ এ সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ৷ আর ২০১৭ সালে অন্যান্য মাদকের সঙ্গে আলোচিত মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে চার কোটি ৮০ হাজার পিস৷ এ বছরে মাদক মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ।

কিন্তু ২০১৭ সালে মাত্র আড়াই হাজার মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে৷ এসব মামলায় দুই হাজার ৬৮০ জন আসামির বেশিরভাগই খালাস পেয়েছেন৷ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর শাস্তি পেয়েছেন এক হাজার ৬৫ জন৷ খালাস পেয়েছেন এক হাজার ৬১৫জন৷

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের প্রথম পাঁচ মাসে মাদক আইনে ৪৯ হাজার ২০৭টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে নিষ্পত্তি করা মামলার সংখ্যা এবং কতজনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে তা জানা যায়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত এ মামলার আসামিদের মাদকসহ ধরা হয়। এরপর আদালতে পাঠানো হয়। আদালত সর্বাজ্ঞ। তিনি (আদালত) বলতে পারবেন তারা (আসামিরা) কোন যুক্তিতে জামিন পান। এ বিষয়ে কিছু বলার এখতিয়ার আমার নেই।’

‘তবে মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি দমন ও আয়কর আইনে গডফাদারদের ধরার সুযোগ আছে। আমরা আটকদের জবানবন্দির ভিত্তিতে কিছু মামলা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছি মানি লন্ডারিং আইনে আনার জন্য’- যোগ করেন তিনি।

মাদক ব্যবসায়ীদের ধরা হয় কিন্তু সাজা হয় না- এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে গেলে আদালত অবমাননা হয়ে যাবে। আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীদের জামিন দেয়ার বিষয়ে কোর্টকে আরও অ্যালার্ট (সতর্ক) হতে হবে। মাদক এখন যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অবস্থা যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, এসব ব্যাপারে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

আরও পড়ুন >> ধরা পড়েছিল ‘ইয়াবাসম্রাট’ ইশতিয়াক?

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ফরহাদ আহমাদ বলেন, ‘বর্তমানে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইনের মামলার কোনো আসামিকে হাইকোর্ট থেকে জামিন দেয়া হয় না।’

তাহলে কেন খালাস পাচ্ছে আসামিরা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ মাদকের মামলা নিয়ে অনেক সময় গড়িমসি করেন। তাদের উচিত আসামি গ্রেফতারের তিনদিনের মধ্যে মাদক মামলার চার্জশিট দেয়া। চার্জশিট পাওয়ার এক-দুই মাসের মধ্যে বিচার শেষ করা। তাহলে আর তাদের জামিনের সুযোগ থাকবে না। এছাড়া অনেক মামলার আসামি আদালতে এসে বলেন যে, পুলিশ তাদের ইয়াবা (অল্প সংখ্যক) দিয়ে চালান দিয়েছে। তখন আদালত তাদের কথা বিশ্বাস করে এবং জামিন দেয়।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু তাদের জামিনে মুক্ত করতে একটি গ্রুপ কাজ করছে। যারা মাদক মামলার আসামিদের জামিনে মুক্ত করতে তৎপর, তাদেরও চিহ্নিতের কাজ চলছে।’

এমনও দেখা গেছে, ১৫-২০ বছর ধরে এ সংক্রান্ত মামলা আদালতে চলমান। আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগরের একটি আদালতে মাদক আইনে ১৯৯৪ সালের ১৯ এপ্রিলের দায়ের করা একটি মামলা এখনও বিচারাধীন যার তদন্ত করছে সিআইডি। দীর্ঘ আট বছর পর ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট করেন আদালত। এরপর ১৬ বছর গত হয়েছে, কিন্তু সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘প্রচলিত আইনের তফসিলে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। যাদের মাদকের গডফাদার বা মাস্টারমাইন্ড বলা হয় তাদের আইনে সোপর্দ করার কোনো ব্যবস্থা বর্তমান আইনে নেই।’

‘আমরা আইন সংশোধন করে, যারা মাদকের ব্যবসা করে এবং মাদক তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আইনানুগ বিধান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’

এআর/এমএআর/এমআরএম/পিআর