পাহাড়ের উপরে গভীর জঙ্গলে ছোট্টি একটি গ্রাম। সেখানে বাস করে অবলুপ্ত হতে বসা প্রাচীন জনজাতি। মেরেকেটে এখন তাদের সংখ্যা ২০০-২২০। কেরলের মলপ্পুরম জেলার এর্নাদ তালুকে সেই হারিয়ে যেতে বসা ‘চোলানায়কর’ জনজাতির এক মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচাতে বৃষ্টির মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ দড়িতে ঝুলে ঝুলে পিচ্ছিল পাহাড়ে উঠে চিকিৎসা করে এসেছেন এক তরুণী সরকারি চিকিৎসক।
Advertisement
জেলার স্বাস্থ্য দফতরের কর্মকর্তারা জানান, এক যুগের মধ্যে এই প্রথম কোনো চিকিৎসক ওই দুর্গম গ্রাম ‘পানাপ্পুঝা উরু’তে পা রাখলেন। পরে স্থানীয় কয়েক জনের সাহায্যে অসুস্থ প্রৌঢ়কে নামিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন তিনি। অস্ত্রোপচারের পর আপাতত বিপদমুক্ত রোগী।
চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান অবনতির যুগে এ ঘটনা একদমই ব্যতিক্রম, যেখানে রোগীকে বাঁচাতে নিজের জীবন বিপন্ন করে নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় দড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠেছেন বছর তিরিশের অশ্বথী সোমান। রোগীকে বাঁচাতে এমন প্রাণান্তর চেষ্টায় প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
সাড়ে চার বছরের শিশুপুত্র ও আড়াই বছরের শিশুকন্যার মা অশ্বথীর বলেন, ‘এই জনজাতির মানুষ সভ্য জগতের সংস্পর্শ এড়িয়ে থাকতে চান। ওই রোগীও সমতলে আসতে চাইছিলেন না। অথচ তার পায়ে পচন ধরেছিল। কড়ে আঙুল খসে গিয়েছিল। এটা জানার পর আমি আর বসে থাকতে পারিনি। টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে হেসে লাজুক গলায় বলেন, ‘আমাকে অবশ্য আত্মীয়-বন্ধুদের অনেকে বকাবকি করেছেন। দড়ি বেয়ে ওঠার সময় পা হড়কালেই খাদে তলিয়ে যেতাম। আমি তাঁদের বলেছি, ভাগ্যে থাকলে মরতাম, বড় হয়ে আমার ছেলেমেয়ে যখন জানতে পারত, তখন আমাকে নিয়ে গর্বই করত।’
Advertisement
মলপ্পুরমের জেলা মেডিকেল অফিসার সাকিনা জানান, গোটা জেলায় তাদের তিনটি মোবাইল ডিস্পেনসারি রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম নীলাম্বুর মোবাইল ডিস্পেনসারি। সেখানে মাস আটেক আগে মেডিকেল অফিসার হয়ে যোগ দেন অশ্বথী। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা ওই এলাকায় একাধিক জনজাতির বাস। এদের মধ্যে একমাত্র ‘চোলানায়কর’-রাই পাহাড়ের উপরে জঙ্গলে থাকেন। প্রতি বুধবার পাহাড়ের নিচে মানচেরি এলাকায় মোবাইল ইউনিটে কেউ কেউ চিকিৎসা করাতে আসেন।
অশ্বথী জানান, গত ১৯ জুন তারা খবর পান ওই গ্রামে রেভি নামে এক মধ্যবয়স্ক খুব অসুস্থ। কিন্তু তিনি ডাক্তারখানায় আসতে ভয় পাচ্ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। ১২ জনের দল তৈরি হয়, যেখানে একমাত্র চিকিৎসক অশ্বথী, বাকিরা মূলত ‘অ্যান্টি নকশাল থান্ডারবোল্ট টিম’-এর সদস্য। ২০ জুন সকালে যাত্রা শুরু হয়।
মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই গাড়ি থেমে যায়। সামনে গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ। অশ্বথীর কথায়, ‘জীবনে কখনও ট্রেকিং করিনি। সেদিন দড়িতে ঝুলে ঝুলে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাহাড়ে চড়তে হয়েছে।’
রেভির প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে হাসপাতালে আসার জন্য অনেক বুঝিয়ে রাজি করান অশ্বথী। পিঠে করে তাকে বয়ে নিচে নামানো হয়।
Advertisement
অশ্বথীর ভাষা বোঝেন না রেভি। কিন্তু এখন তিনি তাকে দেখলেই একগাল হাসেন। অবিশ্বাস ভেঙে চিকিৎসককে ভরসা করতে পারার হাসি।
সূত্র: আনন্দবাজার।
এসআর/আরআইপি