খেলাধুলা

স্তব্ধ, বাকরূদ্ধ মেসি

রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠলো কাজান এরেনার অর্ধেক গ্যালারি। ফাইনাল জয়ের মতই আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল ওঠার আনন্দ তখন ওই অর্ধে। বাকি অর্ধ নীরব-নিস্তব্ধ। মাঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লিওনেল মেসির মত। ৪-৩ গোলে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই যে বিদায় নিতে হলো তাদের!

Advertisement

মেসির চোখে অবিশ্বাস। এভাবেও বিদায় নিতে হবে! এতটা দুর পথ এসে, এককভাবে একটা দলকে এভাবে টেনে এনে বিদায় নেয়ার হতাশা তার চোখেমুখে। চেহারায় কোনো অভিব্যাক্তি নেই। শূন্য দৃষ্টি দুরে কোথাও নিবদ্ধ। গোল করার পর দুই হাতের দুই আঙ্গুল উপরে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে যেভাবে উদযাপন করেন, এবার ঠিক তার উল্টোটা। দৃষ্টি কখনও মাটিতে নিবদ্ধ। কখনও শূন্যে চেয়ে থাকা। হয়তো বা হারের ধাক্কা হজম করার চেষ্টা কিংবা চতুর্থবারের মত বিশ্বকাপ খেলেও জিততে না পারারে বেদনা- সবই তখন মেসির বাকরূদ্ধ চেহারা আর শূন্য দৃষ্টিজুড়ে।

পাহাড় সমান প্রত্যাশা নিয়েই এসেছিলেন বিশ্বকাপে। পৃথিবীর সেরা ফুটবলার তিনি। কেউ কেউ বলেন, এই গ্রহের নন। ভিন্ন গ্রহের। লিওনেল মেসি টানা তিনটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে তুলেছিলেন আর্জেন্টিনাকে। খেলেছেন বিশ্বকাপের ফাইনাল; কিন্তু একবারও শিরোপা উপহার দিতে পারেননি। ২০১৬ কোপা আমেরিকার পর তো ক্ষোভে-অভিমানে অবসরের ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছিলেন; কিন্তু নিজের দেশকে অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করতে, সারা বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তের আহাজারীকে সম্মান দেখিয়ে তিনি আবার ফিরে এলেন।

শুধু ফিরে আসাই নয়, আর্জেন্টিনাকে একা টেনে নিয়ে এলেন রাশিয়া বিশ্বকাপে। বাছাই পর্বে যখন ধুঁকছিল আর্জেন্টাইনরা, তখন মেসিই ছিলেন ত্রাতা। ইকুয়েডরের বিপক্ষে বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচে অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক করে আর্জেন্টিনাকে তুললেন বিশ্বকাপের মঞ্চে।

Advertisement

কোচ হোর্হে সাম্পাওলির অধীনে এই আর্জেন্টিনাকে অনেকেই রেখেছিলেন ফেবারিটের তালিকায়। আবার অনেকে রাখতে চাননি। যারা ফেবারিটের তালিকায় রাখলেন, একটাই কারণ লিওনেল মেসি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা যেমন একক কৃতিত্বে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ শিরোপা উপহার দিলেন, তেমনি যদি কোনো মিরাকল কিংবা ম্যাজিক দেখিয়ে মেসিও জিতিয়ে দেন আর্জেন্টিনাকে!

মেসি নিজেও বার বার বলেছিলেন, ইশ্বর সম্ভবত আমার জন্য একটি শিরোপা লিখে রেখেছেন। আবার কখনও বলেছেন, একটি বিশ্বকাপের জন্য ক্লাবের সবগুলো ট্রফি আমি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু মেসি তো আর একা খেলেন না। খেলে ১১ জনের একটি দল। মেসিকে ঘিরে যারা রয়েছেন, তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি খোদ মেসি নিজেও।

আগুয়েরো, ডি মারিয়া, মাচেরানো, ওতামেন্দি, হিগুয়াইন, পাভন, রোহো- তারকার অভাব নেই। কিন্তু কোচ সময় পাননি। পেলেও ঠিকমত একটি দল হিসেবে আর্জেন্টিনাকে গড়ে তুলতে পারেননি। তবুও মেসি যখন দলটিতে রয়েছেন, তখন আশায় বুক বাধলে তো আর অপরাধ হওয়ার কথা নয়।

সারা বিশ্বের কোটি কোটি সমর্থক আর্জেন্টিনার জয়ের আশায় বুক বেধেছেন। মেসিদের পারফরম্যান্স তুমুল, তুখোড় হবে, ভরিয়ে দেবে সমর্থকদের মন, বার্সেলোনার খেলাই তিনি এখানে টেনে আনবেন- এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে হোঁচট খাওয়াটাই ব্যাকফুটে ঠেলে দিলো আর্জেন্টিনাকে।

Advertisement

পরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত পুরো আর্জেন্টিনা দলকেই বিপর্যস্ত করে ছাড়ে। দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দলের খবর বেরিয়ে পড়ে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে জয়ছাড়া কোনো বিকল্প খোলা নেই। এমন এক সমীকরণের ম্যাচে জ্বলে উঠলেন মেসি। গোল করলেন, করালেন। অসাধারণ এক ম্যাচ উপহার দিয়ে দলকে তুলে আনলেন দ্বিতীয় রাউন্ডে।

কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! দ্বিতীয় রাউন্ডে পড়লো আরেক শক্তিশালী দল ফ্রান্সের সামনে। তবুও মেসি যখন ফর্মে ফিরলেন, তিনি যখন গোল পেলেন এবং দলকে তুলে আনলেন দ্বিতীয় রাউন্ডে, তখন ভক্তরা ভেবেছিল, এই তো রিদম পেয়ে গেছে মেসির আর্জেন্টিনা। কিন্তু ফরাসীদের সামনে এসে আবারও সেই ছন্নছাড়া আর্জেন্টিনাকেই দেখা গেলো।

মেসিকে বল দেয়ার কেউ নেই। ডি মারিয়া অসাধারণ এক শটে হয়তো একটি গোল করেছেন, কিন্তু তিনি সঠিকভাবে একটি বলও দিতে পারেননি মেসিকে। পারেননি অন্য কেউ দিতে। তালিয়াফিকো, মাচেরানো, বানেগা, ওতামেন্দি, রোহো কিংবা অন্য কেউ- মেসিকে বল জোগোনোর কাজটাই সঠিকভাবে কেউই করতে পারনেনি।

কয়েকটা বল মেসি নিজে নিচে নেমে গিয়ে সংগ্রহ করেছেন। পাস দিয়েছেন সতীর্থকে। কিন্তু ফিরতি পাস পাননি তিনি। মেসি নিজেকে মেলে ধরতে পারলেন না মোটেও। তারওপর, সারাক্ষণ তো তাকে বোতলবন্দী করে রাখার পরিকল্পনা ছিলই প্রতিপক্ষের। সুতরাং, আর্জেন্টিনা দলটা এখানেই অর্ধেক পঙ্গু হয়ে গেলো। যার পরিণতি, ৪-৩ গোলে পরাজয়।

শুধু মেসিকে সঠিকভাবে বল দিতে না পারাই নয়, ডিফেন্সটাও সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। না হয়, ৩ গোল দিয়েও ম্যাচ হারতে হতো না। কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ৩ গোল দিয়ে পরাজয়, এই প্রথম আর্জেন্টিনার।

রেফারি যখন শেষ বাঁশি বাজালেন। তখন মেসির শুকনো এবং হতাশামাখা মুখটাই ভেসে উঠলো ক্যামেরার সামনে। বিশ্বকাপের অভিযাত্রা এত দ্রুত, এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে- সেটা মেসি নিজেও কল্পনা করতে পারেননি। না পারার হতাশাই কুরে কুরে হয়তো খাচ্ছে তাকে। কে জানে, অবসরের ঘোষণাটা আবার দিয়ে ফেলেন কি না। এবার অবসরের ঘোষণা দিলে, আর ফেরানো যাবে না এলএম টেনকে।

আইএইচএস/জেএইচ