গত এক দশকে রাজশাহীর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৮৫১ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ৫২ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। মানবিক সহায়তা, গ্রামীণ অবকাঠামো সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবেলা ও পুর্নবাসন, এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসৃজনসহ জনহিতকর বিভিন্ন খাতে দেয়া হয়েছে এই বরাদ্দ। কিন্তু অনিয়মে ভেস্তে গেছে সামাজিক নিরাপত্তা। লোপাট হয়ে গেছে বরাদ্দের একটি বড় অংশ।
Advertisement
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি এমনকি সংশ্লিষ্ট দফতরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা এসব অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ফলে সুফল পায়নি এখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাট হয়েছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচিতে। এ ছাড়া টেস্ট রিলিফ (টিআর), সেতু-কালভার্ট নির্মাণ এবং রাস্তা এইচবিবিকরণ খাতে। কাজ না করেই বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশ আত্মসাৎ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
নয়ছয় হয়েছে মানবিক সহায়তার আওতায় ভিজিএফ ও জিএফ। এ নিয়ে অভিযোগ উঠলেও দোষীরা আইনের আওতায় না আসায় বেড়েছে লুটপাট। তবে অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেছে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন দফতর। চলতি ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে জেলার তানোরে কাবিখার ছয় টন চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠে সরনজাই ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য মাহাতাব আলীর বিরুদ্ধে। তিনি কাজ করে চকপাড়া মোল্লাপুকুরের সুরক্ষা দেয়াল নির্মাণ ও মাটি ভরাটে বরাদ্দ ৬ টন চাল আত্মসাৎ করেন। ওই প্রকল্পে ৮ টন চাল বরাদ্দ ছিলো। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে পরে বরাদ্দ আটকে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়ন দফতর।
Advertisement
ওই অর্থ বছরে তানোর পৌরসভার তালন্দ বাজার মোড় থেকে কলেজ মোড় পর্যন্ত রাস্তায় মেরামতে বরাদ্দ ছিলো এক লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু মাত্র পাঁচ-সাত ট্রলি খোয়া বিছিয়ে প্রকল্পের টাকা তুলে নেন ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনসুর রহমান।
একই অভিযোগ ওই পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বারী, ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সম্ভুনাথ হালদার এবং নারী কাউন্সিলর পলি আক্তারের বিরুদ্ধে। নামমাত্র কাজ করে সম্ভুনাথ হালদার কালিগঞ্জ হাটে রাস্তা মেরামতে বরাদ্দ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং মাটি ভরাটের ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।
অন্যদিকে নামমাত্র কাজ করে আবদুল বারি বুরুজ উত্তরপাড়া থেকে পার্শ্ববর্তী আবদুস সালামের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতে বরাদ্দ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং নারী কাউন্সিলর পলি আক্তার তানোর সাবরেজিস্ট্রার অফিসের সামনে থেকে অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত ৪০ হাজার এবং হঠাৎপাড়া স্কুল সংলগ্ন এলাকায় মাটি ভরাট বরাদ্দের এক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগীরা। তবে প্রতিকার মেলেনি।
সম্প্রতি ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠে পুঠিয়ার জিউপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জয়নাল আবেদিন ও সংরক্ষিক নারী সদস্যর জেসমিন আরা খাতুনের বিরুদ্ধে। তারা শ্রমিকদের তালিকায় পরিবারের লোকজনের নাম উঠিয়েছেন। কাজ না করেই নিয়মিত বরাদ্দ অর্থ তুলে নেন তারা। শ্রমিকদেরও অর্ধেক অর্থ কেটে নেন। এ নিয়ে পরে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন শ্রমিকরা।
Advertisement
ওই অর্থ বছরেই কাবিখা বিশেষ বরাদ্দে দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা ইউনিয়েন পরিষদ এলাকার ২নং ভাঙ্গিরপাড়া এলাকার ইউনুসের বাড়ি থেকে সাদেকের বাড়ি পর্যন্ত নির্মাণ কাজের টাকা দিয়ে পুঠিয়ার বেলপুকুর ইউনিয়নের চক ভাঙ্গিরাপাড়া এলাকায় কাজ হয় নামমাত্র। ওয়ার্ড সদস্য আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে প্রকল্প অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দেয়া হয় জেলা প্রশাসক বরাবর।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গোদাগাড়ীর চরআষাড়িয়াদহ ইউনিয়নে কাঁচা সড়ক সংস্কারের ৯ প্রকল্পে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিলো। একই উপজেলার গোগ্রাম, রিশিকুল, দেওপাড়া ও মাটিকাটায় ৪ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিলো ১০ লাখ টাকা।
এর মধ্যে দিয়াড় মানিকচক স্কুল মোড় থেকে ভুবনপাড়া পাঞ্জাব চেয়ারম্যানের বাড়ি পর্যন্ত সড়কে নামমাত্র কাজ করে বরাদ্দের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে নেন আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ। ওই ইউনিয়নের এরফান মেম্বারের বাড়ি থেকে বিওপি পর্যন্ত সড়কের মাটি ভরাট না করেই বরাদ্দের আড়াই লাখ টাকা তুলে নেন ইউপি সদস্য শামীমা বেগম।
হনুমন্তনগর স্কুল থেকে ইসরাইলের বাড়ি পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার, মানিকচক মন্তাজ আলীর বাড়ি থেকে মোজাম্মেলের বাড়ি পর্যন্ত আড়াই লাখ, দিয়াড় মানিকচক সরকারি প্রাথমিক স্কুলের মাঠ ভরাটে ২ লাখ ৫০ হাজার, শরিফুল মেম্বারের বাড়ি থেকে পাজরাপাড়া জামে মসজিদ পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার, বয়ারমারী সইবুরের বাড়ি থেকে তোজাম্মেলের বাড়ি পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার, ভুবনপাড়া ঈদগাহ থেকে ডাবের মাঠ মসজিদ পর্যন্ত আড়াই লাখ, দিয়াড় মানিকচক থেকে সব্দর হাজীর বাড়ি পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে গোদাগাড়ীর গোগ্রাম ইউনিয়নের আওয়ালের ডিপ থেকে মুলকিডাইং পর্যন্ত সড়ক সংস্কারে ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, রিশিকুল ইউপির নিলধবইল থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার, দেওপাড়ার আভিমান্যুর বাড়ি থেকে বিল পর্যন্ত আড়াই লাখ ও মাটিকাটার সহড়াগাছি লাইনপাড়ার মোকলেসের বাড়ি থেকে সাত্তারের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক সংস্কারে ২ লাখ টাকার পুরোটাই তুলে নেয়া হলেও কোথাও কাজের নমুনা দেখা যায়নি।
তবে যখনই অভিযোগ উঠেছে তখই তদন্ত করে আইনত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিটি রয়েছে। পুরো কাজ তদারকিও করা হয় কঠোরভাবেই। এ নিয়ে বড় ধরণের অভিযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, যথাযথ নজরদারি করতে পারছেন না তারা। কারণ পর্যাপ্ত জনবল নেই তাদের। ফলে ছোটখাটো অভিযোগ উঠছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই দ্রুত আইনত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন থেকে কঠোর নজরদারিও রয়েছে।
তবে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন দফতরের হিসেবে, গত ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত রাজশাহীতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ৮ লাখ ৩১ হাজার ২৫৯টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮৫১ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ৫২ টাকা। এতে পাল্টে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মান।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএ/পিআর