জাতীয়

রাঘব বোয়ালরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে

গত মে মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। ঘোষণা ছাড়াই পৃথকভাবে অভিযান শুরু করে পুলিশ। ঘটে একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা। র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৪ জন নিহত হলেও নিহতের পরিসংখ্যান দিতে অপারগতা প্রকাশ করে পুলিশ সদর দফতর। তবে গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১৫৩ এর কম নয়, গ্রেফতার ৩৫ হাজার।

Advertisement

প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ‘শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত হওয়ার দাবি করা হয়। তবে দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, শীর্ষ ১০ গডফাদারের কেউই এখনও গ্রেফতার কিংবা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হননি।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হওয়ার পরও কেন রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন- এমন প্রশ্নেরও সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে অভিযান নিয়েও। ধারণা করা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের তথ্য আগেই পেয়ে যাচ্ছেন গডফাদাররা। সুযোগ বুঝে সটকে পড়ছেন তারা। যদি এমনই হয়, তাদের অভিযানের তথ্য দিচ্ছেন কারা? 

ঢাকায় মাদকের প্রধান ও সর্ববৃহৎ আখড়া জেনেভা ক্যাম্প। সব বাহিনীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ তিন মাদক ব্যবসায়ী এখানেই থাকেন। এ ক্যাম্প থেকেই তারা ব্যবসা পরিচালনা করেন। 

Advertisement

মাদকবিরোধী অভিযানের শুরুতে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালায় র‌্যাব। দ্বিতীয় দফায় অভিযান চালায় পুলিশ। তবে সেখানে পাওয়া যায়নি শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াক কিংবা নাদিমকে (পঁচিশ)।

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৬ মে র‌্যাবের অভিযানের দুদিন আগে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার খোঁজ-খবর নিতে এসেছিলেন ইশতিয়াক। অভিযানের আগের রাতে উপস্থিত ছিলেন পঁচিশও। কিন্তু অভিযানের দিন তাদের পাওয়া যায়নি।

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা আগে থেকেই মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। তারাই অভিযানের আগাম তথ্য মাদক ব্যবসায়ীদের দেন। এ কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন রাঘববোয়ালরা।

দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর ধরে তেজগাঁও বিভাগের দায়িত্বে আছেন ডিসি (উপ-কমিশনার) বিপ্লব কুমার সরকার। একই বিভাগে সহকারী কমিশনার (এসি), অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেন জালে ধরা পড়ছেন না রাঘবোয়ালরা? পুলিশ কি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে? ডিসি বিপ্লব জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইশতিয়াকসহ অনেকে গডফাদার এলাকায় থাকে না। অভিযানের সময় তারা আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশ তাদের ধরার জন্য যথেষ্ট তৎপর। তারা এলাকায় থাকে না, বাইরে থেকে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করে।’ 

Advertisement

জেনেভা ক্যাম্প মোহাম্মদপুর থানার আওতাভুক্ত। রাঘববোয়ালদের না ধরার কারণ হিসেবে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামালউদ্দিন মীর বলেন, ‘শীর্ষদের কয়েকজনকে একাধিকবার গ্রেফতার করা হলেও তারা জামিন নিয়ে বের হয়ে আসে। অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। ইশতিয়াক হয়তো বাইরে চলে গেছে, যদিও আমি নিশ্চিত নই। তবে গডফাদারদের ধরার চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ 

জেনেভা ক্যাম্পের অভিযানে শীর্ষ কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করতে পারেনি এলিট ফোর্স র্যাব। কেন এই ব্যর্থতা- এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘অভিযান চালাতে গেলে অনেকেই গাঢাকা দেয়। সেক্ষেত্রে তাদের খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।’

‘অভিযান শুধু তালিকার ওপর নির্ভর করেই পরিচালিত হয়- এমন নয়, তালিকা ছাড়াও যারা জড়িত তাদের ধরাও অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমরা চেষ্টা করছি, আত্মগোপনকারীদের আইনের আওতায় আনা হবেই।’ 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অভিযানে অনেককে গ্রেফতার করা হয়। যারা চিহ্নিত, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। শীর্ষ ব্যবসায়ীদেরও খোঁজা হচ্ছে। একজনকে (নাদিফ ওরফে পঁচিশ) গ্রেফতারের পর সে জামিনে বের হয়ে যায়। আমরা ফের তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। তাদের পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ 

এদিকে জেনেভা ক্যাম্পের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ক্যাম্পটি মাদকমুক্ত না করার পেছনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। ক্যাম্পটি স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের অন্যতম ‘আয়ের উৎস’। ক্যাম্পের পাশে অবস্থিত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অফিস। মোহাম্মদপুর থানা তো রয়েছে। পুলিশের কিছু কর্মকর্তা ও সদস্য নিয়মিত সেখান থেকে মাসোয়ারা পান বলে দাবি স্থানীয়দের।  

সরেজমিন জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তার অভিযোগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জেনেভা ক্যাম্পের পাশের এসবি অফিসের সব কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়। বদলি হওয়াদের মধ্যে পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) কয়েক মাস পর আবারও সেখানে ফিরে আসেন। অভিযোগ আছে, তিনি জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ী সালামের কাছ থেকে সপ্তাহে ২০ হাজার টাকা করে আদায় করেন। এছাড়া মোহাম্মদপুর থানার আরেক এসআই সাপ্তাহিক ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে গোয়েন্দা তথ্য মাদক ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করেন। 

সরাসরি পুলিশের সংশ্লিষ্টতা থাকায় জেনেভা ক্যাম্প থেকে মাদকমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। 

এ বিষয়ে অভিযুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

পুলিশের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ নতুন নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি বিপ্লব বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে ২-৪ টা কথা (সমালোচনা) বলতে মানুষ উৎসাহবোধ করে। এ বিষয়ে মানুষ এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। পুলিশের সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নই আসে না।’ 

মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামালউদ্দীন মীর বলেন, ‘আগে অনেকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসতো। সন্দেহজনক কেউ থাকলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে বদলি করা হয়। বর্তমানে এমন কোনো অভিযোগ নেই। আর তথ্য ফাঁসের অভিযোগ তো কোনোভাবেই সত্য নয়।’

‘সর্বশেষ জেনেভা ক্যাম্পে মাদকবিরোধী একটি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। সেই অভিযানের বিষয়ে শুধুমাত্র পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা জানতেন। অভিযান শুরুর ৩০ মিনিট পর মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়।’

পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পুলিশের প্রায় ৭০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগরের গুলশান, ওয়ারী, মতিঝিল ও তেজগাঁও অঞ্চল, পুলিশের কল্যাণ ট্রাস্ট, পরিবহন শাখা ও দাঙ্গা দমন বিভাগের (পিওএম) ২৩ জন, যশোরের ১০ জন, টাঙ্গাইলের সাতজন, বগুড়ার চারজন, নোয়াখালীর তিনজন, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং হাইওয়ে পুলিশের দুজন করে; খাগড়াছড়ি, সিলেট, হবিগঞ্জ, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ, বরিশাল ও সিলেটে একজন করে এবং র‌্যাবের তিন সদস্য রয়েছেন। 

এআর/এমএআর/পিআর