খেলাধুলা

‘আমি ছিলাম ভ্যাকুয়াম হেল্পার, দুই ভাই পরিষ্কার করতো জানালা’

আমাদের বাড়িটা ঠিক গরম হতো না, জানেন! একটা বড় ফায়ারপ্লেস ছিলো ঠিকই; কিন্তু ওই যে পুরনো বাড়ি হলে যা হয় আর কি। বাসেলের একটা ফার্মের ভেতর পুরনো বাড়িতে আমরা থাকতাম। এ রকম জায়গায় পুরনো বাড়ি হলে যা হয়, একেবারে সে রকম। বরফের মতো ঠান্ডা বাড়ি। সেটা নিয়ে আমি তেমন এতটা মাথা ঘামাইনি। ঘামিয়ে লাভটা কি? মোটামুটি উন্মাদের মত চারপাশ দৌড়ে আমি গা গরম রাখতাম। ঠান্ডা নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিলো না বেচারা আমার বড় ভাইয়ের। হবে নাই বা কেন? বেচারার ঘরটা ছিলো ফায়ারপ্লেস থেকে অনেকখানি দূরে। তাও আবার দোতলায়। শীতের দিনে গায়ের উপর গোটা পাঁচেক কম্বল চাপিয়ে ঘুমুতে হতো ওর।

Advertisement

যুদ্ধের ঠিক আগ দিয়ে আমার পরিবার কসোভো ছেড়ে পাড়ি জমায় সুইজারল্যান্ডে। আমার বয়স তখন চার। সাথে আমার আরো দুই ভাই আর বাবা-মা। বেচারারা তিন ছেলে নিয়ে এসে সুইজারল্যান্ডে থিতু হতে চাচ্ছিলেন। কাজটা কিন্তু সহজ নয়, খুব কঠিন ছিলো। বয়স্ক গাছের শিকড় উপড়ে আরেক জায়গায় নিয়ে লাগানোর পর বাঁচানো যেমন কঠিন, বিষয়টা সে রকম। তার উপর আমার বাবা সুইস জার্মান ভাষাটা পারতেন না। তাই তাকে প্রথমেই কাজ করতে হয়েছে রেস্তোরাঁর কিচেন সিঙ্কে। থালা বাসন ধুয়ে দিতেন। পরে বাবা অবশ্য রাস্তার কনস্ট্রাকশন-এর কাজ পেয়েছিলেন। মা কাজ করতেন ক্লিনারের। শহরের অফিস বিল্ডিং এ ছিলো তাঁর কাজ। মায়ের সাথে আমরা তিন ভাইও থাকতাম। আমি ছিলাম ভ্যাকুয়াম হেল্পার আর আমার দুই ভাই পরিস্কার করতো জানালা।

সুইজারল্যান্ড খুব খরুচে দেশ। আমার বাবা মায়ের জন্যে বিষয়টা ছিলো আরো বেশি কঠিন। তারা কসোভোয় থেকে যাওয়া আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য টাকা পাঠাতেন। প্রথম প্রথম আমরা বিমানে চেপে কসভোয় আত্মীয়স্বজনদের দেখতে যেতাম। ওই বয়সের কথা আমার মনে থাকার তো কথা নয়। মায়ের গল্পে জেনেছি যে আমরা বিমানে চেপে যেতাম। মা বলতেন, ‘প্লেনে তুই একটা ছিলি আস্ত শয়তান! সিট বেয়ে উঠে সবসময় পেছনের সিটের লোকজনকে ধরতে চাইতি! চুপ থাকা কাকে বলে ওইসময় যদি তোকে শেখানো যেতো!’

যুদ্ধ শুরু হবার পর সবকিছু খুব কঠিন হয়ে গেলো। কসোভোয় যাওয়াতো অসম্ভব। যারা ওখানে আটকা পড়েছিলো তাদের জন্যে সময়টা খুব কঠিন হয়ে গেলো। আমার চাচার বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আরো অবর্ণনীয় সব কষ্ট। বাবা যতটা বেশি সম্ভব টাকা পাঠানোর চেষ্টা করতেন তখন। প্রয়োজনের চাইতে বেশি একটা পয়সাও খরচ করার কোন উপায় আমাদের ছিলো না। শুধু এক জন্মদিনে একটা অতিরিক্ত জিনিস উপহার পেয়েছিলাম।

Advertisement

মজার গল্প আসলে!! রোনালদো হচ্ছে আমার আইডল। মানে ওই ব্রাজিলের রোনালদো আর কি। দ্য পারফেক্ট নাম্বার নাইন। ওর খেলাটা আমার কাছে যাদু মনে হতো। একেবারে নির্ভেজাল যাদু। ৯৮’র ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে রোনালদো ইনজুরড ছিলো, হেরেও বসলো একেবারে লেজে গোবরে করে। এই রোনালদো লোকটার জন্যে আমার খুব মায়া লাগছিলো। কষ্ট হচ্ছিলো মানুষটার জন্যে। ওই বয়সে কি আর কষ্টটা নেয়া যায়! কেঁদেছি শুধু রোনালদোর জন্য। খুব বেশি কেঁদেছি। বিশ্বকাপের মাস তিনেক পরেই আমার সপ্তম জন্মদিন ছিলো। মায়ের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলাম, ‘জন্মদিনে আমাকে রোনালদোর হলুদ জার্সি কিনে দিতে হবে। আর কিচ্ছু লাগবে না। ও মা, আমার রোনালদোর জার্সি লাগবে…।’

জন্মদিনের দিন মায়ের হাতে একটাই বাক্স দেখা গেলো। আমার জন্যে। খুলে দেখলাম সেই জার্সি। রোনালদোর হলুদ জার্সি। বাজারে নকল পাওয়া যায় না? ওরকম একটা। নকলই তো হবে, আসলটা কেনার টাকাটাই বা কোথায় আমাদের! বাক্স খুলে আর তর সইছিলো না। জার্সিতে ব্রাজিলের ব্যাজ আছে কি না সেটাও আমার দেখার কথা মাথায় নেই। হলুদ একটা গেঞ্জি, পিছনে সবুজ রঙে ৯ লেখা। আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত! প্রতিদিন আমি এই জার্সিটা পরেছি, টানা প্রায় দশদিন চলেছে জার্সির উপর স্টীম রোলার। সেই জার্সির সাথে আবার হলুদ শর্টস। সেগুলো চেপেই ঘুরতাম।

স্কুলে একমাত্র অভিবাসী শিশু আমিই, আর কেউ নেই। সুইস বাচ্চাগুলো বুঝতো না, আসলে আমি কেন ফুটবল নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি, কেন আমার সবটা জুড়ে শুধু ফুটবল। সুইজারল্যান্ডে ফুটবল শুধুই একটা খেলা, ডালভাত টাইপ। দুনিয়ার অনেক জায়গায় ফুটবলের আরেক নাম জীবন, সুইজারল্যান্ডে বিষয়টা তেমন না। আমার সবটাতেই ফুটবল, উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝবেন।

চার বছর পর, ২০০২ বিশ্বকাপে রোনালদো মাথায় এক অদ্ভুত চুলের ছাঁট নিয়ে আসলেন খেলতে। ত্রিভূজাকৃতি। দেখেই তো মাথায় ভূত চাপলো। সোজা হেয়ারড্রেসারের কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমাকে রোনালদো ছাঁট দিয়ে দিন’। আমার মাথার চুল ব্লন্ড এবং তার উপরে কোঁকড়া। ব্লন্ড কোকড়া চুলে ঐ ছাঁট! পাগলা কাজকারবার আর কাকে বলে! ওরকম চুল নিয়ে গেলাম স্কুলে। সবাই হতভম্ব। কেউ কিছু বলেনি; কিন্তু মনের কথাটাতো বোঝা যায়! সবাই ভাবছিলো আসলে, শালার হইছে কি? করছেটা কি মাথায়?

Advertisement

আমি ওসব পাত্তাটাত্তা দেইনি। আমি ওরকমই। আমার স্কুলটা ছিলো শহরের ভালো এলাকায়, আর আমার বাসা ছিলো সবচে খারাপ এলাকার পাশে। বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ; কিন্তু মজাটা কি জানেন, এলাকা খারাপ হলেও ভালো ফুটবল খেলাটা ওখানেই হতো। ওখানে যেতে মা পই পই করে বারণ করতেন। কে শোনে কার কথা? প্রতিদিন স্কুল শেষে হেঁটে রওনা দিতাম ওখানে। শুধু খেলার জন্যে। সুইজারল্যান্ড সম্পর্কে লোকজনের খুব ভালো ধারণা, গোটা দেশটা আসলেই ভালো। কিন্তু এই পার্কটা…। এই পার্কটা পুরো পাগলা।

প্রতিটা দল ইউনাইটেড নেশনস এর মতো। টার্কিশ আছে, আফ্রিকান আছে, সার্বিয়ান, আলবেনিয়ান…। একদম সব। আর শুধু তো ফুটবল না; সবাই আবার ওই পার্কে ঘুরতে যাচ্ছে, একপাশে জার্মান হিপহপ বাজছে। ছেলেপুলে ফ্রি-স্টাইল র্যাপিং করছে, আবার হঠাৎ দেখা গেলো খেলার মাঝে একেবারে মাঝখান দিয়ে মেয়েরা হেঁটে চলে যাচ্ছে। অদ্ভুত জায়গা।

পার্ক যেমনই হোক, ফুটবলটা হতো আসল। রিয়েল ফুটবল যাকে বলে। প্রায়ই মাঠে ঘুষোঘুষি দেখা যেত। এ ওকে ধরে ঘুষোচ্ছে। ও ওকে ধরে পেদিয়ে বিষ ঝেড়ে দিচ্ছে। আমি অবশ্য ওরকম মার খাইনি। মুখটা সবসময় বন্ধ রাখতাম তো। তাই মনে হয় মার খেতে হয়নি; কিন্তু ওই পার্কে খেলাটা আমাকে আসলেই সাহায্য করেছে। ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম কিভাবে বড়দের সাথে খেলতে হয়। তাও যেনতেন বড় মানুষ না। এরা খুব সিরিয়াস ধরনের খেলোয়াড়। মজা করতে খেলে না।

আমার বয়স যখন ১৪ বছর, এফসি বাসেল যুব দলে খেলছি। প্রাগে নাইকি কাপে খেলার সুযোগ পেলাম। সমস্যা হয়ে গেলো, যে ওই কাপে খেলতে গেলে কয়েকদিন স্কুল মিস করতে হয়। টিচারকে বললাম, সোজা মানা করে দিলেন। সুইজারল্যান্ডে টিচারেরা স্কুলিং খুব সিরিয়াসলি নেন। তাই না করাটাই স্বাভাবিক। ভাবলাম, খাইছে! তাহলে অসুস্থ্য হওয়ার অভিনয় ছাড়া গতি নেই।

বাড়িতে এসে মাকে দিয়ে ফ্লু বা এরকম একটা কিছুর নোট লিখিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। চলে গেলাম প্রাগ। ওই টুর্নামেন্টে আমি খুব, খুবই ভালো খেলেছিলাম। এখানেই প্রথমবারের মতো অন্য দেশের ছেলেপিলেদের দেখলাম অবাক হয়ে আমার খেলা দেখছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস। এইতো, এই ব্যাটাই বাসেল থেকে এসেছে। থাকে না? বোঝা যায়তো আসলে, চেহারার দিকে তাকালেই। খুব গর্ব হলো বিষয়টায়। দারুণ এক অনুভূতি।

প্রাগ থেকে ফেরত গিয়ে সোমবার গেলাম স্কুলে। তখনও ভাব ধরে আছি, আমি এখনো অসুস্থ। বোঝেন তো! মিথ্যা বলতে সেটা সত্যি প্রমাণের জন্য অভিনয়টা তো করাই লাগে। আমাকে দেখেই টিচার বললেন, ‘জারদান, এদিকে এসো। তাড়াতাড়ি…।’ হাত-টাত নেড়ে ডাকছেন ভদ্রলোক। লক্ষণ সুবিধের লাগলো না। স্যারের ডেস্কের কাছে গেলাম। একটা খবরের কাগজ টেবিলে ঠাস করে ফেলে বললেন, ‘অসুস্থ, তাই না?’ দেখি কাগজের একদম প্রথম পাতায় আমার ছবি। একদম ক্যালানো একটা ছবি, হাতে প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট ট্রফি। স্যারের দিকে তাকানোর সাহসই হলো না। দুই হাত তুলে দিয়ে শ্রাগ করলাম, মনে মনে বললাম, মারছে। শ্যাষ একদম!

টুর্নামেন্টের পর দেখলাম বেশ ভালোই মনোযোগ পাচ্ছি। তখনও আমাদের পরিবারের জন্য সমস্যা একটাই, টাকা। কারণ আমার বাকী দুই ভাইও তখন বাসেল এ খেলছে। যখনই আমাদের কোন টুর্নামেন্টে যাবার জন্যে টাকা দিতে হয় বা অন্য কিছু, আমাদের খরচ তিনগুণ। আমার বয়স যখন ১৬, তখন স্পেনের এক জায়গায় একটা ক্যাম্প আয়োজন করা হলো। স্কিল বাড়ানোর জন্যে আরকি, টাকা লাগবে। কতো? ৭০০ সুইস ফ্রাঁ বা এরকম কিছু একটা। এক রাতে আমার বাবা আমাকে এসে বললেন, ‘সম্ভব না রে বাপ। এত টাকা আমার হাতে নাই।’

তো কি করা যায়? আমরা তিনভাই মিলে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আমাদের আশপাশের এলাকার লোকজনের লনের ঘাস কাটলাম সপ্তাহ তিনেকের মতো। আমার এক ভাই, ঠিক জানি না ওর কাজটা কি ছিলো। তবে প্রতিদিন একেবারে সেইফটি গ্লাসটাস নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখতাম। নিশ্চয়ই কোন ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। তো যেভাবেই হোক, একেবারে শেষ মুহুর্তে তিন ভাই এর টাকা মিলে যোগাড় হলো ৭০০ ফ্রাঁ। গেলাম স্পেনে। ক্যাম্পে যেতে পারবো না এরকম কোনো ভয় আমার হয়নি। ভয়টা কি নিয়ে ছিলো জানেন? আমার টিমমেটরা বুঝে ফেলছে যে টাকাটা দেয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। এই ভয়টা আমার ছিলো। গরীবের ভাই কিছু থাকুক আর নাই থাকুক আত্মসন্মানবোধটা আছে।

বাচ্চা ছেলেপুলে কোন মাত্রার শয়তান হয় বোঝেন তো! বিশেষ করে এই ১৬/১৭ বছর বয়সের ছেলেপুলে। আমার অক্ষমতা নিয়ে নির্দয় সব রসিকতা করে একেবারে ভেঙে ফেলবে সবকিছু। খুব অমানবিক হয় এ সময় মানুষজন। ট্রেনিং শেষে সবাই কিওস্ক থেকে খেতে যেতো। আমাদের তো কখনোই টাকা ছিলো না, আমরা একটা না একটা উসিলা বানিয়ে বাড়িতে ফেরত আসতাম। পেটে তখন তীব্র ক্ষিদে। এই ক্ষিদেটা সম্ভবত আমাকে অন্যভাবে সাহায্য করেছে। সেরাদের বিপক্ষে খেলার তীব্র ক্ষিদেটা বাড়িয়েছে হয়তো এই ক্ষিদেটা। সবসময়।

একবছর পর আমি ডাক পেলাম বাসেল ফার্স্ট টিমে খেলার। বয়স তখন ১৭। আমাকে ম্যাচের শেষের ২০ মিনিটের জন্য নামানো হলো। মনে হলো ভালোই খেলেছি। তো পরেরদিন আবার গেলাম ট্রেনিং-এ। আমাদের ইয়ুথ টিম কোচ ডেকে বললেন, ‘কি করলি গতকাল? ভাবিস কি তুই নিজেরে?’

আমি বললাম, ‘মানে কি? কি বলছেন কোচ?’‘আমি মাত্র ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছি। উনি বললেন তুই নাকি শুধু ড্রিবলিং করে বেড়িয়েছিস। তুই আবার সেকেন্ড টিমে। যা ভাগ এখান থেকে।’

বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম। মনে হচ্ছিলো বাসেল-এ আমার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই। সব শেষ। দুই সপ্তাহ পর ওই ম্যানেজারকেই বরখাস্ত করা হলো। নতুন ম্যানেজার এলেন। তিনি আমাকে ফার্স্ট টিমে ডেকে নিলেন। তারপর আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে একটা মজার ব্যাপার ছিলো তখন। ম্যানেজার আমাকে খেলাতেন লেফট ব্যাক পজিশনে…। অথচ আমি বল বানাতে এবং আক্রমণ করতে পছন্দ করি। ডিফেন্ডারেরা শুধু চিৎকার করত মাঠে, ‘নিচে আয়, নিচে নাম হারামজাদা!’

হা হা হা হা হা! কি আর বলবো, বলুন? তবে কাজ হয়েছিলো বেশ। কারণ খবরের কাগজগুলোতে দেখতাম নিয়মিত লেখা হচ্ছে, শাকিরির বিশ্বকাপ দলে ডাক পাওয়া উচিৎ…। এইসব আরকি। কোত্থেকে কি হচ্ছিলো আমি জানি না। ভাবতেও পারছিলাম না। শেষমেষ যখন দলে ডাক পেলাম, খুব আবেগের একটা ব্যাপার ছিলো আমার জন্যে। খবরটা পেয়ে সোজা বাবা-মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে ছুটে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা তো মহা খুশি। সবকিছু কেমন দ্রুত হয়ে গেলো। ১৬ বছর বয়সে স্পেনের ক্যাম্পে যাওয়ার জন্যে আমি লোকের বাগানের ঘাস কাটছি, সেই আমি ১৮ বছর বয়সেই বিমানে চড়ে বসছি দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ খেলার জন্যে। অদ্ভুত না?

স্পেনের বিপক্ষে যেদিন খেললাম, সেদিনকার কথা খুব মনে আছে। খেলতে নেমে দেখি আমার সামনে ইনিয়েস্তা দৌড়াচ্ছে! খেলা বাদ দিয়ে মাথায় এলো, আরে! এই লোকটাকে তো আমি টিভিতে খেলতে দেখি! কি অদ্ভুত! এসব কিছুর পরেও একটা বিষয় আমার আজীবন মনে থাকবে। আমরা যখন প্রথম আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম, দেখি প্রত্যেকের রুমের সামনে বিশাল এক বন্দুক নিয়ে আর্মির লোক দাঁড়ানো। প্রত্যেকটা দরজায়! আমাদের পার্সোনাল আর্মি! আমার জন্যে এই ঘটনাটা হচ্ছে খুব ‘কুল’ একটা ঘটনা। মাত্র বছর খানেক আগেও আমি খারুজ একটা এলাকার পার্ক থেকে রাতের বেলায় একা একা ফিরেছি…। আর এখন আমার নিজস্ব আর্মি গার্ড!

বাবা-মায়ের জন্যে আমার বিশ্বকাপ খেলার মুহুর্তটা খুব গর্বের। বেচারারা একেবারে খালি হাতে সুইজারল্যান্ড এসেছিলেন। সারা জীবন তার বাচ্চাদের জন্য, সুন্দর একটা জীবন দেয়ার জন্যে ভয়াবহ পরিশ্রম করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় সুইজারল্যান্ড বিষয়ে আমার অনুভূতিটা মিডিয়া ভালো করে বোঝেনি। বা ভুল বুঝেছে। আমার মনে হয় আমার বাড়ি দুইটা। খুবই সিম্পল একটা ব্যাপার। সুইজারল্যান্ড আমার পরিবারকে সব দিয়েছে। আমিও চেষ্টা করি সুইজারল্যান্ড দলটাকে আমার সবটুকু দিতে। আবার যখন কসোভোতে যাই, জায়গাটাকে খুব আপন মনে হয়। কোনো যুক্তি নেই জানি। স্রেফ আবেগ বলতে পারেন। আবেগের তো কোনো যুক্তির প্রয়োজন হয় না।

২০১২ সালে যখন আলবেনিয়ার বিপক্ষে খেললাম, তখন আমার বুটে সুইজারল্যান্ড, আলবেনিয়া আর কসভোর পতাকা লাগানো। সুইজারল্যান্ডের কয়েকটা কাগজ বিষয়টাকে খুব খারাপভাবে উপস্থাপন করলো। খারাপ ধরনের সব লেখা ছাপলো। ভয়াবহ সমালোচনার মুখে পড়ে গেলাম। আরে ভাই, এইতো আমার পরিচয়, এ নিয়েও যে কেউ অদ্ভুত সব কথাবার্তা ভাবতে পারে সেটাই তো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

সুইজারল্যান্ডের সবচে ভালো দিক কি জানেন? যারা দারিদ্রতা থেকে মুক্তি বা যুদ্ধ থেকে বেঁচে যারা একটা সুস্থ জীবন চায়, বেঁচে থাকতে চায় সুইজারল্যান্ড তাদেরকে স্বাগত জানায়। সুইজারল্যান্ডে লেক, পর্বত ইত্যাদি আছে। পৃথিবীর স্বর্গ বলতে পারেন। এসবের পাশেই আবার আছে আমার খেলার মতো একটা পার্ক যেখানে টার্কিশ, সার্বিয়ান, আলবেনিয়ান, আফ্রিকানরা খেলে। জার্মান র্যাপার গান গায়, মেয়েরা মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। সুইজারল্যান্ড আসলে সবার জন্যে। সবার।

এবারেও যখন বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছি, আমার বুটে আছে সুইজারল্যান্ড আর কসভোর পতাকা। কোনো রাজনীতি বা এরকম কোন কারণে না। থাকবে কারণ এই দুই পতাকা আমার জীবনের কথা বলে।

আরআর/আইএইচএস/আরআইপি