জাতীয়

ঢামেকে অকেজো সিটি স্ক্যান মেশিন : বিপাকে রোগীরা

গেল রমজানে রাজধানীর বংশালের মালিটোলায় নিজ বাসায় সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা পিছলে নিচে পড়ে যায় ৫ বছর বয়সী শিশু নুর মোহাম্মদ খান। এতে তার মাথায়, বাম পাশের চোখ ও কপালে অাঘাত লাগে। সঙ্গেসঙ্গে চোখ, কপাল ও মাথার পেছনের অংশ ফুলে যায়। ব্যথায় অস্বাভাবিক অাচরণ করতে থাকে শিশুটি। সে তার মা ও অাশপাশের স্বজনদের চিনতে পারছিল না সে সময়। চিন্তিত হয়ে পড়েন স্বজনরা।

Advertisement

এমতাবস্থায় শিশুটির মা জেরিন খান তাকে নিয়ে দ্রুত চলে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। চিকিৎসক শিশুটির চিকিৎসা শুরুর অাগেই তার মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে কি না তা পরীক্ষার জন্য সিটি স্ক্যান রিপোর্ট অানতে বলেন। পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসা, ওষুধপত্র ও পরামর্শ দেয়া হবে বলে জানান জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ওই চিকিৎসক। কিন্তু মা জেরিন খান শিশুটির মাথার সিটি স্ক্যান করতে গিয়েই পড়লেন বিপাকে।

হাসপাতালের নার্সদের পরামর্শে তিনি জরুরি বিভাগ থেকে বহির্বিভাগে দৌড়ে যান ছেলের মাথার সিটি স্ক্যান করানোর জন্য। সেখানে গিয়ে দেখেন সিটি স্ক্যান মেশিনটি নষ্ট। তাই সেখান থেকে একজন টেকোলজিস্টের পরামর্শে তিনি যান হাসপাতালের নতুন ভবনে থাকা অারেকটি সিটি স্ক্যান মেশিন রুমে। সেখানে গিয়ে দেখেন, সেটিও সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধ। এতে তিনি শঙ্কায় পড়ে যান ছেলেকে নিয়ে।

শিশুটির মা জেরিন খান এ প্রতিবেদককে বলেন, ডাক্তার ছেলেকে (শিশুটি) দেখে সিটি স্ক্যান করাতে বললেন। এরপর একবার জরুরি বিভাগে একবার নতুন বিল্ডিংয়ে সিটি স্ক্যান মেশিন খুঁজতে খুঁজতে অামি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। বহির্বিভাগেরটা নষ্ট। অাবার নতুন বিল্ডিংয়েরটা সন্ধ্যা ৬টার পর খুলবে। তাও অাবার লম্বা সিরিয়াল। এমতাবস্থায় ছেলেকে বাঁচানোর শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলাম অামি। এ সময় জরুরি বিভাগ থেকে বহির্বিভাগ এবং নতুন বিল্ডিংয়ে রোজা রেখে দুপুরবেলা তীব্র রোদে দৌড়াদৌড়িতে অামি নিজেই যেন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম।

Advertisement

তিনি বলেন, পরে নিরূপায় হয়ে শাশুড়ির পরামর্শে ঢামেক হাসপাতাল থেকে ছেলেকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যাই। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা করতে এসে এমন দুর্ভোগে পড়বো জানলে বাসার পাশেই যেকোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতাম বলে অাক্ষেপ করেন তিনি। তার মতে, ঢামেক হাসপাতালে ছেলের জন্য চিকিৎসা নিতে এসে উল্টো তিনি ও তার সঙ্গে থাকা দুজন স্বজনও দৌড়াদৌড়িতে অসুস্থ হতে বসেছিলেন।

শুধু জেরিন খান নন, নরসিংদীর উত্তরবাগহাটা থেকে মাথায় অাঘাত নিয়ে মেহেদী হাসান (১৬), মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থেকে অাসা সিয়াম রশিদসহ (৩৮) অগনিত রোগীর স্বজনরা পড়ছেন এমন দুর্ভোগে। এসব ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের মাঝে ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে চরম চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

সম্প্রতি শাহবাগে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় মাথায় গুরুতর অাঘাত পান পুলিশ সদস্য অাশরাফুল অালম (৪৫)। পরে তাকে সকাল ১০ টার দিকে উদ্ধার করে ঢামেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দুপুর ২টার দিকে তার মাথার সিটি স্ক্যান করতে চেয়েছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু হাসপাতালের মেশিনটি সন্ধ্যা ৬টার অাগে চালু না হওয়ায় ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল তার মাথার অাঘাতের রিপোর্ট পেতে। তিনি এখনও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (অাইসিইউ) চিকিৎসাধীন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢামেক হাসপাতালে সিটি স্ক্যান মেশিন রয়েছে মাত্র দুটি। বহির্বিভাগে একটি, অন্যটি জরুরি বিভাগ সংলগ্ন নতুন ভবনে। বহির্বিভাগের মেশিনটি প্রায় এক বছর ধরে নষ্ট। পুরো হাসপাতালে একটি মেশিন থাকায় সেটিতে রোগীদের সিরিয়াল অনেক লম্বা হওয়ায় জরুরি চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়।

Advertisement

ওই একটি সিটি স্ক্যান মেশিনে ক্যান্সার বা টিউমার নির্ণয়, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, হৃদযন্ত্রের কোনো রোগ বা রক্ত প্রবাহে কোনো বাধা, ফুসফুসের রোগ, কিডনি বা মূত্রসংবহন তন্ত্রের কোনো রোগ বা পাথর শনাক্তকরণ, পিত্তথলি, লিভার বা অগ্নাশয়ের রোগ নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়া যেসব রোগীকে পেস মেকার, ভাল্ভ বা এ জাতীয় যন্ত্র দেয়া হয়েছে তাদের সমস্যাও নির্ণয় করা হয়।

তাই মেশিনটির ওপর চাপ বেশি। এ জন্য মেশিনটি ২৪ ঘণ্টায় তিন ধাপে সচল রাখা হয়। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা এবং রাত ১ টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলে ওই মেশিনে। অাগে দুটি মেশিন সচল থাকায় রোগীদের দুর্ভোগ ছিল কম। কিন্তু একটি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট থাকায় দুর্ভোগ চরম অাকার ধারণ করেছে।

এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালের টেকনোলজিস্টদের ইনচার্জ কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বহির্বিভাগের সিটি স্ক্যান মেশিনটি গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর কারিগরি ক্রুটিজনিত কারণে বিকল হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। সর্বশেষ কয়েকদিন অাগে মেশিনটির কোম্পানি মেডিটেটের লোকজন এটির সচলের বিষয়ে পরিচালককে জানিয়েছেন। অাশা করছি, অাগামী সপ্তাহে এটি চালু হতে পারে।’

ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একে এম নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, মেশিনটি ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গা থেকে অনুমোদন পেয়েছি। অাশা করছি, অাগামী সপ্তাহখানেক বা ১০-১৫ দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। সিটি স্ক্যান মেশিনটি ছাড়া বিকল অন্যান্য যেসব মেশিন রয়েছে সেগুলোও এ সময়ের মধ্যে ঠিক করা হবে।

এসএইচ/জেডএ/আরআইপি