পোল্যান্ড দলের অন্যতম মূল ভরসার প্রতীক রবার্ট লেওয়ানডস্কি। নিঃসন্দেহে তাদের ইতিহাসের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও পোলিশদের আশার আলো ছিলেন এই ফুটবল তারকা; কিন্তু ক্লাব ও দেশের হয়ে সফলতা পাওয়া এই ফুটবলারের সাফল্যের পেছনে রয়েছে এক হৃদয়বিদারক গল্প।
Advertisement
জার্মান বুন্দেসলিগার ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে খেলা এই স্ট্রাইকার তার দেশের হয়ে ইতোমধ্যেই নাম লিখেছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায়, করেছেন ৫৫ গোল। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে যখন মস্কোর স্পার্টাক এরেনায় সেনেগালের বিপক্ষে মাঠে নামেন তিনি, তখন সাথে ছিল একটাই দুঃখ।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে রবার্ট লেওয়াডস্কির পেশাদার ফুটবল অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হয়; কিন্তু ঠিক তার আগের বছরই তার আদর্শ, খেলা পাগল বাবা তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যান, না ফেরার দেশে। দেখে যেতে পারেননি ছেলের পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নযাত্রা। ক্রিজিসতফ লেওয়াডোস্কি খেলাধুলায় তার অর্জনের জন্য বেশ সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে জুডো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি তিনি হুটনিক ওয়ার্শ ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগের ফুটবলও খেলেছিলেন।
লেওয়াডস্কির পরিবারের জন্য খেলাধুলাটাই ছিল প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে। তার মা ইভোনাও একজন প্রো-ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন। তাই এটা অনেকটাই অনুমেয় যে, ছেলেবেলায় থাকা রবার্ট লেওয়াডস্কি তার বাবা-মা’র পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।
Advertisement
খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল তার। আর তাই ছেলের এই আগ্রহ দেখে তাকে পার্টিজেন্ট লেসজনোয়ের অনুশীলন সেশনে নিয়ে যেতেন। সেখানে খুব তাড়াতাড়িই সবার নজর কাড়েন ছোট্ট লেওয়াডস্কি।
আজকের এই ক্ষুরধার স্ট্রাইকার ছেলেবেলায় খেলা শুরু করেছেন ঘাসহীন, শক্ত বালুর মাঠে। ছিলো না এখনকার মতো এতো পর্যাপ্ত সুবিধা। ঠান্ডায় অসম্ভব বেকায়দায় পড়তে হত তাকে। এতো বাধার পরেও রবার্ট ফুটবল থেকে সরে আসেননি। লেগে ছিলেন তার স্বপ্ন পূরণ করার মিশনে। মাত্র ৭ বছর বয়সেই ডেলটা ওয়ারশ ক্লাবে যোগদান করেন রবার্ট। যেটি ছিল পোলিশ পঞ্চম ডিভিশনের একটি ক্লাব এবং এটি সুপরিচিত ছিল দেশের অন্যতম বড় ক্লাব লেগিয়া ওয়ারশ’তে সরাসরি তরুণ খেলোয়াড় সরবরাহকারী হিসেবে। তাই রবার্টের জন্য এটি ছিল অনেক বড় একটি সুযোগ।
এভাবেই শুরু হয়েছিল সতীর্থদের কাছে পরিচিত হওয়া ‘লেভি’র ফুটবল যাত্রা, যে কি-না ধীরে ধীরে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলছেন মাঠে। লেগিয়ার স্কাউটরা তরুণ লেওয়াডস্কির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মাঠে একের পর এক গোল করা, লড়াকু মানসিকতা দেখে তারা আগ্রহী হয় রবার্টের ব্যাপারে। ঠিক যখনই ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু হচ্ছিল রবার্টের, তখনই প্রথম ধাক্কাটা আসে লেভির জীবনে।
২০০৫ সালে তার বাবা ক্রিজিসতফের একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন হয়; কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত ক্যান্সারে ভোগা ক্রিজিসতফ স্ট্রোক করার কিছুদিন পরেই মৃত্যুবরণ করেন। বাবার এ মৃত্যুতে ওই সময় প্রচণ্ডভাবে ভেঙ্গে পড়েন রবার্ট। সম্প্রতি, এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাবার মৃত্যু আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। হঠাৎ করে আমি একা হয়ে যাই এবং আমি বুঝতে পারি, আমাকে একা বেড়ে উঠতে হবে, বড় হতে হবে। বাবার স্মৃতি আমাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়।’
Advertisement
মায়ের উপর আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য রবার্ট ওয়ারশ’তে তার বোন মিলেনার ছোট্ট ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেন। ডেলটাতে থাকাকালীন যা কিছুই অর্জন করেছেন, সব তার মা এবং বোনের সাথে ভাগাভাগি করেছেন। তার মা ইভোনা পরবর্তীতে তার প্রফেশনাল ভলিবল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেন। তরুণ লেওয়ানডস্কিকে লেগিয়া এক বছরের চুক্তিতে নেয় এবং প্রায়ই তাকে প্রথম দলের সঙ্গে অনুশীলনে রাখতো; কিন্তু, অনুশীলনে ভারসাম্য রাখতে না পেরে ইনজুরির শিকার হন রবার্ট। এক বছর পর লেগিয়া তরুণ রবার্টকে ছেড়ে দেয় এবং কোন ধরনের ম্যাচ খেলা ছাড়াই শেষ হয়ে যায় তার চুক্তি। এতে তার ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে যায়।
একজন গোলদাতার অভাবে ভুগতে থাকা তৃতীয় বিভাগের ক্লাব নিকজ প্রুসজকৌ দলে ভেড়ায় তরুণ রবার্ট লেওয়ানডস্কিকে, যে চুক্তির জন্য দু’পক্ষই ধন্যবাদ প্রাপ্য। দলটির হয়ে প্রথম মৌসুমেই ইনজুরি থেকে ফিরে ২৯ ম্যাচে ১৬টি গোল করেন লেওয়াডস্কি। তার বয়স ছিল তখন মাত্র ১৭ বছর। ১ বছর পর পোলিশ দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন রবার্ট। ৩২ ম্যাচে মোট ২১টি গোল করেছেন এই স্ট্রাইকার। ২০০৮ সালে তৎকালীন ১.৫ মিলিয়ন পোলিশ অর্থমূল্যে তাকে দলে ভেড়ায় লেস পোজনান।
লেওয়ানডস্কি এর পরপরই পোল্যান্ডেরসেরা লিগে খেলার সুযোগ পেয়ে যান; কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার এই সফলতা তার বাবা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে রবার্ট বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর আমাকে খুব তাড়াতাড়ি প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হয়েছিল।’
তার বাবার বিশ্বাস ছিল, লেওয়ানডস্কি অনেক বড় ফুটবলার হবেন। এ কারণে নাম রাখার ক্ষেত্রেও তিনি অনেক বাছ-বিছার করেন। রবার্ট বলেন, ‘তিনি জানতেন আমি দেশের বাইরে যেয়ে খেলবো এবং এজন্য তিনি আমার নাম রবার্ট রেখেছিলেন। যাতে কেউ আমার নাম নিয়ে কোন ভুল না করে। আমার অনেকবার আক্ষেপ হয়েছে এই বলে যে, কিছু জিনিস তার সাথে বলতে পারিনি। আমার আক্ষেপ রয়েছে, তিনি আমার সিনিয়র ক্যারিয়ারের ম্যাচ দেখতে পারেননি এবং কোনদিনই দেখতে পারবেন না। আশা করি, তিনি উপর থেকে ঠিক আমাকে দেখছেন, আমার খেলা দেখছেন। এটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।’
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে পোল্যান্ড দলের মূল খেলোয়াড় লেওয়ানডস্কি। তাদের সকল প্রত্যাশা তাকে ঘিরেই। প্রথম ম্যাচেই সেনেগালের কাছে হোঁচট খেয়েছে তার দল। পরের ম্যাচে যদিও কলম্বিয়ার কাছে ইতিমধ্যেই বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেছে লেওয়াডস্কিদের। তিনি কি আজ (বৃহস্পতিবার) পারবেন পোল্যান্ডের বিশ্বকাপ যাত্রার শেষটা বর্ণিল করে তুলতে? অন্তত একটি জয় হলেও নিজের দেশকে উপহার দিতে। যেন উপর থেকে ছেলে এই কৃতিত্ব দেখে তার বাবাও আত্মায় শান্তি পেতে পারেন!
আরআর/আইএইচএস/পিআর