খেলাধুলা

এশিয়ার পতাকা এখন জাপানের হাতে!

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা, নেইমারের ব্রাজিল আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল বহাল তবিয়তে দ্বিতীয় পর্বে। আইসল্যান্ডের সাথে ড্র আর ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হারের পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু মনে হলেও শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আবার দপ করে জ্বলে উঠেছে মেসির দল।

Advertisement

তুলনামূলক কম শক্তির সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দিন নিজেদের খুঁজে পায়নি ব্রাজিলিয়ানরা। ১-১ গোলে ড্র করা হলুদ জার্সির দলকে জয়ের দেখা পেতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে । কোস্টারিকার সাথে গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে দুই গোলে জিতলেও গোল পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে ইনজুরি সময় পর্যন্ত। অবশেষে বুধবার রাতে সার্বিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে জ্বলে উঠেছে নেইমারের ব্রাজিল।

ওদিকে আগে-ভাগে দ্বিতীয় পর্ব নিশ্চিত রোনালদোর পর্তুগালেরও। প্রথম দিন স্পেনের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস লড়াই অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ করা পর্তুগাল দ্বিতীয় খেলায় মরক্কোকে হারিয়েই মোটামুটি সেরা ষোলোয় নাম লিখিয়ে ফেলেছে। এরপর শেষ ম্যাচে ইরানকে হারাতে না পারলেও সমস্যা হয়নি, রোনালদোরা ঠিকই পৌঁছে গেছে দ্বিতীয় পর্বে।

ওদিকে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশীয় ফুটবলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি উরুগুয়ে আর স্বাগতিক রাশিয়া ‘এ’ গ্রপ থেকে সেরা ষোলোয়।

Advertisement

এছাড়া ‘বি’ গ্রপ থেকে ইউরোপের গাণিতিক ছন্দময় ফুটবল শৈলির দেশ স্পেনও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের পর্বে উঠে গেছে। ‘সি’ গ্রুপে ইউরোপের দুই দল ফ্রান্স-ডেনমার্ক, ‘ডি’ গ্রপ থেকে ক্রোয়েশিয়া-আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় পর্বে। ‘ই’ গ্রুপ থেকে ব্রাজিলের সাথে পরের পর্বে পা রেখেছে সুইজারল্যান্ড। ‘এফ’ গ্রুপে জার্মানদের বিদায়ঘণ্টা বাজানো দক্ষিণ কোরিয়াকে তৃতীয় হয়েই তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সেখান থেকে ১৬ দলে জায়গা করে নিয়েছে সুইডেন আর মেক্সিকো।

‘জি’ গ্রুপ থেকে ইংল্যান্ড-বেলজিয়াম এক ম্যাচ বাকি রেখেই পরের পর্ব নিশ্চিত করেছে। আজ (শুক্রবার) গ্রুপ পর্বে শেষ দিন আসলে ‘এইচ’ গ্রুপের ভাগ্য নির্ধারণী রাত। সেনেগাল আর জাপান ম্যাচ ড্র হয়ে গেলে দু’দলই সেরা ষোলোয় নাম লিখবে। আর যে জিতবে তারও পরের পর্ব শতভাগ নিশ্চিত হবে।

মোটকথা, আজ ভোর হওয়ার আগে, মধ্য রাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড; কিন্তু তারও আগে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার কিছুক্ষণ আগেই জানা হয়ে যাবে, আসলে গ্রুপ পর্ব থেকে শেষ পর্যন্ত কোন ১৬টি দল পরের পর্বে খেলবে।

আগেই জানা, গ্রপ পর্বের প্রায় শেষ দিকে এসে ঘটেছে এবারের আসরের সবচেয়ে বড় অঘটন। ৮০ বছরের মধ্যে প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে জার্মানি। ১৯৩৮ সালে শেষবার প্রথম পর্বে বাদ পড়েছিল জার্মানরা। সেটাই শেষ। এরপর জার্মানির বিশ্বকাপ রথ থামেনি সহজে। এরপর ১৭ বিশ্বকাপ আসরে চারবারের (১৯৫৪, ১৯৭৪, ১৯৯০, ২০১৪) বিশ্বসেরা হয়েছে তারা। চারবারের রানার্সআপও (১৯৬৬, ১৯৮২, ১৯৮৬ ও ২০০২) হয়েছে। আর সেমিফাইনাল খেলেছে চারবার।

Advertisement

বাকি চারবারের তিনবার কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছে। অর্থাৎ এবারে আগে গত ৭৪ বছর বিশ্বকাপের সর্বশেষ সবকটা আসরে সেরা আট দলের ভিতরে ছিল জার্মানি। এবার সে ইতিহাসের ব্যতিক্রম ঘটলো। ৮০ বছরের মাথায় এসে ফাইনাল, সেমিফাইনাল আর কোয়ার্টারফাইনালে খেলা বহুদুরে সেরা ষোলোয়ও জায়গা পেল না বেকেনবাওয়ার, মুলার, রুমেনিগে, ক্লিন্সম্যান, লোথার ম্যাথাউসের দেশ। ছিটকে পড়লো গ্রুপ পর্ব থেকেই।

যদিও ইতিহাস-পরিসংখ্যান জানাচ্ছে সর্বশেষ তিন বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরাই পরেরবার প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে। সেদিক থেকে এটা একটি অতি কাকতালীয় ঘটনা। ২০০৬ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি চারবছর পর, মানে ২০১০ সালে ঠিক পরের আসরেই। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল। ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন স্পেনও ২০১৪ সালে ঠিক পরের আসরের প্রথম পর্বেই বাদ পড়েছিল।

সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে এবার আর প্রথম পর্বের প্রাচীর টপকানো হলো না জার্মানির। ২০১৪ সালের বিশ্বসেরা জার্মানরা বুধবার রাতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে এবার একদম শুরুতেই বাদ পড়লো। জার্মান রথ থামিয়ে দিল দক্ষিণ কোরিয়া। জার্মানদের শৌর্য্য-বীর্য্য আর জারি-জুরি শেষ কোরিয়ানদের কাছে; কিন্তু হায়! দুঃখজনক হলেও সত্য দক্ষিণ কোরিয়াও কিন্তু প্রথম পর্বের প্রাচীর টপকে সেরা ষোলোয় পা রাখতে পারেনি। গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়েছে তারা।

শুধু দক্ষিণ কোরিয়াই নয়, এশিয়ার অপর দুই দল সৌদি আরব আর ইরানও বাদ পড়েছে। টিকে শুধু আছে জাপান। এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি জাপান, যারা এখনো দ্বিতীয় পর্বে খেলার সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছে। আজ (বৃহস্পতিবার) পোল্যান্ডের সাথে গ্রুপের শেষ ম্যাচ ড্র করলেও জাপানিরা পৌঁছে যাবে দ্বিতীয় পর্বে। জিতলে তো কথাই নেই।

জাপান শেষ পর্যন্ত সেরা ষোলয় থাকবে কি থাকবে না, তা আজ বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার খানিক্ষণ আগেই জানা হয়ে যাবে। জাপান পরের পর্ব খেলা মানে এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বকাপে টিকে থাকা। এশিয়ার চার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সৌদি আরব আর ইরান খেলতে এসেছিল এবার মূল পর্ব। সেখান থেকে জাপান ছাড়া বাকিরা বিদায় নিয়েছে।

এখন দেখার বিষয় সেরা ১৬ দলের লড়াই এশিয়া মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে কি না? ৩২ দলে ছিল এশিয়ার চার দল। অনুপাত করলে দাড়ায় ৮ : ১। তার মানে আট ভাগের এক ভাগ দল ছিল এশিয়া মহদেশের (ওশেনিয়া অঞ্চলকে এখানে ধরা হয়নি)। তার ৯০ শতাংশ বিদায় নিয়েছে। একটি দেশের সম্ভাবনা সলতে হয়ে জ্বলছে। খালি চোখে মনে হবে এবারের বিশ্বকাপে এশিয়া ব্যর্থ এবং দিনকে দিন এশিয়ার ফুটবলের মান বুঝি নিম্নমুখি।

কিন্তু আসলেই কি তাই? নাহ, কোরিয়া, ইরান ও সৌদি আরব বিদায় নিয়েছে বলেই যে এবারের বিশ্বকাপে এশিয়ার পারফরমেন্স খারাপ- তা বলা যাবে না। বরং অপরাপর মহাদেশগুলোর সাথে বিশেষ করে আফ্রিকার সাথে তুলনা করলে এশিয়ার পারফরমেন্স বেশ ভাল। জার্মানির মত প্রচণ্ড শক্তিশালী দলকে শেষ ম্যাচে রীতিমত পর্যদুস্ত করে ছেড়েছে কোরিয়ানরা।

৯০ মিনিটের লড়াইয়ে এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি জার্মানি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, আর কোরিয়া র্যাঙ্কিংয়ে অনেক পিছনের দল। এশিয়ার দলগুলোর পারফরমেন্স, প্রাপ্তি, অর্জন ও কৃতিত্ব মূল্যায়নে আরও তিনটি ম্যাচের ফল বড়-সড় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

এক. আফ্রিকার অন্যতম সেরা ফুটব শক্তি মরক্কোর বিপক্ষে ইরানের জয়,দুই. সৌদি আরবের কাছে আফ্রিকার আরেক পরাশক্তি ও নিয়মিত বিশ্বকাপ খেলতে আসা মিসরের পরাজয়।

এতো গেল ইউরোপ আর আফ্রিকার দলগুলোকে হারানোর ফিরিস্তি। অন্যদিকে লাতিন ফুটবলের প্রতিষ্ঠিত শক্তি কলম্বিয়াকে হারানোর রেকর্ডও আছে এবার। গ্রুপ ম্যাচে লাতিন ফুটবলের রাফ এন্ড টাফ দল কলম্বিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছে জাপান।

হ্যাঁ, এটা সত্য যে প্রথম দিন স্বাগতিক রাশিয়ার কাছে সৌদি আরবকে ৫ গোল হজম করতে দেখে অনেকেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সমালোচকরা তীর্যক ভাষায় বলতে শুরু করেছিলেন, এশিয়ার দলগুলোর আয় উন্নতি হচ্ছ না। তারা কি শুধুই অংশ নিতে আসে?

এশিয়ান ফুটবল শক্তিগুলোর কাছে কি বিশ্বকাপ এখনো স্বপ্নের এক জগত। সেখানে পা রাখাই শেষ কথা। জয়-পরাজয় বুঝি বিবেচ্য নয়। কিন্তু, মাঠে জাপান, কোরিয়া এবং ইরান ও সৌদি আরব চার দল অন্তত একটি করে ম্যাচ জিতে সে ধারণাকে অমূলক ও মিথ্যে প্রমাণ করে ছেড়েছে। বরং মনে হয়েছে, এশিয়াও উঠে আসছে। হয়ত সেদিন আর খুব বেশি দুরে নয়, যখন সেরা ষোলয় এশিয়ার অন্তত দুটি দল থাকবে। কোয়ার্টারফাইনালেও এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

কে জানে, এবার জাপানও হয়তো অনেকদূর চলে যেতে পারে! যে দল কলম্বিয়ার মত প্রচন্ড গতিময় ও আক্রমনাত্মক ফুটবল খেলা দলকে হারাতে পারে, সে দল ইউরোপের পোল্যান্ডকে হারাতে পারবেই না এমন ভাবার পক্ষে যুক্তি কম। তারপরও এবারের আসর সব সম্ভবের আসর হিসেবে পরিগণিত। এখানে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন অঘটন ঘটছে। বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞ ও ফুটবল পন্ডিতদের অনেক হিসেবই মেলেনি।

তাই জাপান সেনেগালকে হারাবেই- তা নিশ্চিত করে বলার অবকাশ নেই।

এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি