গোপালগঞ্জের প্রতিবন্ধীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই পাচ্ছেন প্রতিবন্ধী ভাতা। আর এ প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অধিকাংশই অস্বচ্ছল। কিন্তু অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন মাত্র ৩ হাজার ৮’শ ৯৪ জন। জন প্রতি ৫’শ টাকা করে মাসিক ভাতা দেয়া হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে এসকল প্রতিবন্ধীর অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। জেলা সমাজ সেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ জেলায় মোট ১৮ হাজার ৮’শ ৮০টি প্রতিবন্ধী পরিবারে মোট ২০ হাজার ৩’শ ৪ জন প্রতিবন্ধী রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ১২ হাজার ৪’শ ৯ জন, নারী ৭ হাজার ৮’শ ৮২ জন ও হিজড়া (থার্ড জেন্ডার) ১৩ জন।এর মধ্যে জেলার সদর উপজেলায় ৪ হাজার ৮’শ ৫৭ জন, টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় ২ হাজার ২’শ ৬০ জন, কোটালীপাড়ায় ২ হাজার ৩’শ ৩১ জন, মুকসুদপুর উপজেলায় ৫ হাজার ২৫ জন, কাশিয়ানী উপজেলায় ৪ হাজার ৩’শ ৭৮ জন ও গোপালগঞ্জ পৌরসভায় ৪’শ ৯৯ জন প্রতিবন্ধী রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০১২ সাল থেকে জেলায় পাইলটিং বেসিসে প্রতিবন্ধী জরিপ কাজ শুরু করা হয়। এটি এখনও চলমান রয়েছে। তবে তালিকাভুক্ত হয়নি এমন প্রতিবন্ধীও রয়েছে অনেক। জরিপ চলাকালীন এলাকায় অবস্থান না করায় এরা বাদ পড়ে। অনেকে আবার সামাজিক মর্যাদার কারণে তালিকাভুক্ত হয়নি। এছাড়া দুর্ঘটনা ও রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তারা নাম তালিকাভুক্ত করেনি। জেলায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি চালু আছে। মোট ৬’শ ৮২ জনকে এ বৃত্তি দেওয়া হয়। প্রাথমিক স্তরে ৩’শ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪’শ ৫০ টাকা , উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬’শ টাকা ও উচ্চতর শিক্ষায় ১ হাজার টাকা করে প্রতি ৩ মাস অন্তর চেকের মাধ্যমে বৃত্তির টাকা দেওয়া হয়।প্রতিবন্ধীদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে নাম মাত্র সার্ভিস চার্জে সুদ মুক্ত ঋণ চালু রয়েছে। জেলায় বর্তমানে ৮’শ ৬৬ জন প্রতিবন্ধী এ ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৮৬ লাখ ২ হাজার ৬৩৫ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ প্রাপ্ত প্রতিবন্ধীরা যথাসময়ে টাকা পরিশোধ করলে তাদের অনুদান দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জেলা শহরে সরকারি একটি বধির স্কুল থাকলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসংখ্য প্রতিবন্ধী। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিচালনায় গোপালগঞ্জে বর্ণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১’শ ৫৩ জন।সংস্থার নির্বাহী প্রধান অর্পণ বালা লাকী জানান, সকল শিক্ষার্থী তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রথম শ্রেণি থেকে ৫ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়।এদের মধ্যে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পায় ৬ জন এবং শিক্ষা উপবৃত্তি পায় ৫৩ জন শিক্ষার্থী। বর্তমানে পৌরসভার গাড়ি গ্যারেজে স্কুলটির কার্যক্রম চলছে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুরাতন মানিকদাহ এলাকার প্রতিবন্ধী বিজয় দাসের (১০) মা চিত্রা দাস বলেন, জম্ম থেকেই তার ছেলেটি বাক প্রতিবন্ধী। শহরের বর্ণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে বর্তমানে সে শিশু শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। স্বামী প্রশান্ত দাসের টিউশনির টাকায় টানা পোড়েনের মধ্যে তাদের সংসার চলে। প্রতিবন্ধী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী হিসেবে তার সন্তানটি কোনো ভাতা পাচ্ছেন না। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জেলায় ২টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চলছে। এর মধ্যে একটি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় এবং অপরটি টুঙ্গিপাড়ায়। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রের কনসালটেন্ট ডা. মো. আনিসুজ্জামান জানান, সেবাকেন্দ্র থেকে ফিজিওথ্রেরাপি, অকোপেশনাল থেরাপি, স্পিচ ল্যাংগুয়েজ থেরাপি, চক্ষু ও কর্ণ পরীক্ষাসহ কাউন্সিলিং সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে একটি অটিজম কর্ণারও। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে প্রধান ৪টি সেবা বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।তিনি আরো বলেন, চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনামূল্যে হুইল চেয়ার, ট্রাই সাইকেল ও সাদা ছড়িসহ বিভিন্ন সহায়ক উপকরণ দেয়া হয়। কিন্তু হিয়ারিং এইড এর চাহিদা থাকলেও সরবরাহ না থাকায় কেন্দ্র থেকে তা দেয়া যাচ্ছে না। মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় জনবল প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। টুঙ্গিপাড়া প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রটিও একই সমস্যায় জর্জরিত বলে জানা গেছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী ও গোপালগঞ্জ শহরের নবীনবাগের হুমায়ূন কবীরের মেয়ে শ্রবণ প্রতিবন্ধী রুবাইয়া কবির নিটোল জানান, প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত জেলা শহরের সেবা ও সাহায্যকেন্দ্রটি থেকে যে সেবা, সাহায্য ও উপকরণ প্রদান করা হয় তা অপ্রতুল। আমি হিয়ারিং এইড ছাড়া একেবারে শুনতে পারি না।তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি আমার হিয়ারিং এইডটি বিকল হয়ে যাওয়ায় আমি সেখানে গিয়ে কোন সহযোগিতা পাইনি। বর্তমানে আমি একেবারে অচল হয়ে পড়েছি। আমার পড়ালেখা, স্বাভাবিক কাজকর্ম ও নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। একটি হাই পাওয়ারফুল হিয়ারিং এইড কিনতে কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার টাকার প্রয়োজন। যা আমার দরিদ্র বাবার পক্ষে জোগাড় করা খুবই কঠিন।গোপালগঞ্জ জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সমীর মল্লিক বলেন, প্রতিবন্ধী জরিপ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখনো যারা তালিকাভুক্ত হতে পারেনি তাদের তালিকাভুক্তির কাজও এগিয়ে চলছে। প্রতিবন্ধিতার মাত্রা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করা হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, জেলায় ওয়ান লাইন ডাটা এন্ট্রির কাজ চলছে। ডাটা এন্ট্রির কাজ শেষে প্রতিবন্ধীদের সুবর্ণ নাগরিক হিসেবে জাতীয় নাগরিক আইডি কার্ডের আদলে সকলকে আইডি কার্ড দেয়া হবে।এসএস/পিআর
Advertisement