কুরআনুল কারিম কল্যাণের এক মহাগ্রন্থ। এ মহাগ্রন্থে আল্লাহ তাআলা মানুষের দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণের বিষয়গুলোই তুলে ধরেছেন। কারণ তিনি মানুষকে অনেক ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষের কল্যাণ ছাড়া তিনি কোনো কিছুই ভাবেন না।
Advertisement
সুদ ব্যক্তি ও সমাজের জন্য এক মহামারী ব্যাধি। এ ব্যাধির কারণে সমাজের সার্বিক সুখ-শান্তি বিনষ্ট হয়। যে কারণে আল্লাহ তাআলা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর এমন এক সময় সুদের ভয়াবহতা ও খারাপ দিকগুলো তুলে ধরেছেন; যখন অন্ধকার সমাজে সুদের বেড়াজালে মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছিল।
আগের আয়াতগুলোতে সুদের ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াত দুটিতে আল্লাহকে ভয় করে সুদের বাকি অর্থের দাবি ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু ইসলামি সরকারের একটি বিধানও উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামি শাসন পরিচালিত দেশে যদি কোনো ব্যক্তি সুদের দাবি ছাড়তে না চায় তবে সে দেশের শাসকের দায়িত্ব হলো সুদখোরকে তাওবা পড়ানো এবং তাতেও যদি সুদ থেকে কোনো বিরত না হয় তবে তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করা। তবে তার প্রতি যেন কোনোভাবে জুলুম করা না হয় সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
Advertisement
আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে সুদের সে সব কথা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করে বলেন-
আয়াতের অনুবাদ
আয়াত পরিচিতি ও নাজিলের কারণ
সুরা বাকারার ২৭৮ ও ২৭৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুদের দাবি ত্যাগ করার জন্য ঈমানদারকে নসিহত পেশ করেছেন এবং তাঁকে ভয় করার উপদেশ দিয়েছেন।
Advertisement
পাশাপাশি যার সুদের দাবি বা সুদ বর্জন না করতে তাতের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণার কথাও বলা হয়েছে। তবে এ সব বিষয়ে যাতে কেউ কারো প্রতি কোনো ধরণের অত্যাচার না করে সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।
সুদের দাবি বর্জন সম্পর্কি বিষয়ে হজরত ইকরামা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন যে, এ আয়াত ‘ছাকিফ’ গোত্রের ৪ ভাই মাসউদ, আব্দুল ইয়ালিল, হাবিব এবং রাবিয়া সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। আর এ ৪ জনই ওমর ইবেনে আমিরের সন্তান ছিল।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এ আয়াত হজরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা সম্পর্কে নাজিল হয়। আর এ দু’জনই জাহেলি যুগে ছাকিফ গোত্রের বনি ওমর ইবনে আমিরকে সুদে ধার দিতেন। আর উভয়ে একে অপরের ব্যবসার অংশীদার ছিলেন।
ইসলামের আবির্ভাবের পর তাদের অনেক সুদের অর্থ মানুষের কাছে ছিল। সে সূত্রে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করে তাদেরকে আল্লাহর ভয় অর্জনের এবং সুদের দাবি থেকে ফিরে আসতে তাগিদ দেন।
এ সুদের প্রথা ছিল জাহেলি যুগে খারাপ ও নিকৃষ্ট প্রথা। যা আজকের সমাজেও বিদ্যমান। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেলি যুগের সব খারাপ ও নিকৃষ্ট প্রথা ও কাজের ব্যাপারে বিদায় হচ্ছে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন-
‘তোমরা ভাল করে শুনে নাও! জাহেলিয়াত যুগের সব বিষয় আমার পদতলে দলিত হয়েছে। জাহেলিয়াত যুগের খেুনের প্রতিশোধ আর নেয়া হবে না। সর্ব প্রথম আমি আমার নিজ বংশের তরফ থেকে রবিয়া বিন হারেসের খুনের প্রতিশোধ রহিত ঘোষণা করছি। (রবিয়া ছিল বনি হাসের গোত্রের দুগ্ধপোষ্য। বনি হোজাইল তাকে খুন করেছিল)
জাহেলি যুগের সুদও রহিত করে দেয়া হলো। সর্বাগ্রে আমি আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ গ্রহণ বন্ধ করছি। আব্বাসের তরফ থেকে সব সুদ মাফ করে দেয়া হলো।’ (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও ইবনে কাসির)
আরও পড়ুন- নামাজ ও জাকাত কোন ধরনের ইবাদত (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭৭)
অন্য বর্ণনায় এসেছে হজরত আব্বাস ও হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার কিছু যব ‘সলম’ নিয়মে বেচা-কেনা করেছিলেন। ফসল কাটার সময় যখন হলো তখন যবের মালিক বললেন, ‘যদি আপনি আপনার হক পুরোপুরি নিয়ে নেন তবে আমার ছোট ছোট সন্তানদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
এজন্য যদি আপনার হক অর্ধেক এখন গ্রহণ করে এবং বাকি অর্ধেকের জন্যে একটি সময় নির্দিষ্ট করে দেন তবে ভাল হয় এবং তখন আমি আপনাকে আপনার হকের দ্বিগুণ প্রদান করবো।’
এ প্রস্তাবে উভয়ে সম্মত হয়। এরপর যখন নির্দিষ্ট সময় আসলো তখন আগের প্রস্তাব অনুযায়ী অতিরিক্ত দ্বিগুণ শষ্য দাবি করা হলো।
এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবহিত হয়ে উভয়েক এমনি অতিরিক্ত দেয়া-নেয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন এবং আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাজিল করলেন। তখন উভয় সাহাবি এ নির্দেশ পালন করলেন এবং আসল মাল গ্রহণ করে অতিরিক্ত মাল তথা সুদে ছেড়ে দিলেন।
অন্য আয়াতে সুদখোরের কঠিন শাস্তির ঘোষণা রয়েছে তা ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, কেয়ামতের দিন সুদখোরদের বলা হবে অস্ত্র ধারণ কর এবং আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও।হজরত কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুদখোরদের ধ্বংসের কথা ঘোষণা করেছেন। তাদেরকে অপমানিত করার যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন। অতএব, এমন অন্যায় থেকে আত্মরক্ষা করা কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেরই একান্ত কর্তব্য।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর বিধানের যথাযথ বাস্তবায়ন ও তাকে ভয় করার তাওফিক দান করুন। পরস্পরের প্রতি জুলুম করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। সুদের ভয়াবহ প্রথা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর