মতামত

সেই কালরাতের কালনিদ্রা আমাদের চোখে আর নেই

১৯৭৫ সাল। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন চলমান আগস্ট। চলমান বটে- তবু ১৫ আগস্টের সেই স্তম্ভিত ভোরের আকাশ, বাতাস আর এই চরাচর দীর্ণ বিদীর্ণ হয়েছিল। একটি ভয়ঙ্কর ভোরের পায়ের কাছে সমগ্র আগস্ট একসঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। মুখ থুবড়ে পড়েছিল ১৯৭৫ সালটিরই ১২ মাস-  আপাদ-মস্তক! শুধু কি তাই? মুখ থুবড়ে পড়েছিল সমগ্র বাঙালি জাতি, বাঙালির সামগ্রিক ইতিহাস। বিশ্ববিবেক প্রশ্নবিদ্ধ ও সচকিত হয়ে উঠেছিল এ কেমন জাতি, কেমন এই দেশ আর এই দেশের মানুষ- যারা নির্বিঘ্নে জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে! হত্যা করতে পারে সপরিবারে জাতির জনককে! বিশ্ববিবেক এই ১৫ আগস্টের মতো আর কোনো দিন এতটা বিমর্ষ হয়েছিল কি না আমরা জানি না। সালানুক্রমিকের ধারায় ১৯৭৫ সালটি, ক্যালেন্ডারে বিন্যস্ত আগস্টের এই পাতাটি, মানব সভ্যতার ইতিহাস ও ভবিষ্যৎকে কলঙ্কিত করেছে। বাঙালি জাতিসত্তাকে নিঃস্ব করে চিহ্নিত একটি ঘাতক গোষ্ঠী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির মুক্তিচেতনার স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। রক্তপিপাসু পিতৃঘাতকের দলের লোভাতুর, ক্ষমতালিপ্সু ও হায়েনাসুলভ আক্রমণের আক্রোশে রেহাই পায়নি শিশু রাসেলও। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নারকীয় ঘটনা বিরল। বিরল সেই হত্যা-উত্তর উল্লাসের ঘটনাও। ১৫ আগস্টের এই হত্যাকাণ্ড কেবল ব্যক্তিগত বা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা নয়- এই হত্যাকাণ্ড বাঙালিত্বের চেতনার, এই হত্যাকাণ্ড বাঙালির জেগে উঠার বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার। রাষ্ট্রপালিত ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনভাবে বাঙালির এগিয়ে যাওয়াকেই সেদিন হত্যা করেছিল। ১৫ আগস্টের বেদনাবিধুর দিনটিতে সীমাহীন উল্লাসে মেতেছিল ঘাতকেরা। নারকীয় সেই উল্লাসের ধারা নানাভাবে উদযাপনের নজির বঙ্গবন্ধুহীন এই বাংলাদেশে আমরা এখনো প্রত্যক্ষ করি। সমগ্র জাতি যখন শোকস্তব্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সাথে শহীদ হওয়া সকলের শোকে বিহ্বল ঠিক তখনই আমরা দেখি ঘাতকের নির্মম উল্লাসের চিত্র। এই চিত্রে বিগত কয়েক বছর ধরে হঠাৎ যুক্ত হয়েছে একটি ‘বে-জন্মদিন’ পালনের উৎসব ও উল্লাস। শোকের এই দিনটি বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার উল্লাসে-মাতা বাজারের সর্ববৃহৎ কেক কেটে ‘বে-জন্মদিন’-এর উৎসব পালন বিগত কয়েক বছরে সকলের একরকম গা-সওয়া গেছে যেন। দিনটি ম্যাডাম জিয়ার ‘বে-জন্মদিন’ অর্থাৎ এটি আসলে তার জন্মদিন নয়। প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া বা থাকা পর্যন্ত তার মাথায় এই দুর্বুদ্ধি ঢুকেনি যে, ১৫ আগস্টকে জাতির ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে এটি একটি উপায় হবে। পরে, আওয়ামী লীগকে চিরতরে ধ্বংস করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৫ আগস্টকে তিনি তার জন্মদিন বানিয়ে ফেললেন। বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার জীবিত থাকলে হয়তো বিস্ময় প্রকাশ করে বলেই উঠতেন ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’  ম্যাডামের বিবাহ রেজিস্ট্রি সার্টিফিকেটে জন্মদিন দেখানো হয়েছে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫। তিনি যখন প্রথম পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন তখন তার সেই পাসপোর্টে জন্ম তারিখ ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬। আবার, ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ উপলক্ষে গণমাধ্যমে প্রচারিত তার জীবনবৃত্তান্তে জন্মদিন দেখানো হয়েছে ১৯৪৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে ১৫ আগস্টকে দলীয়ভাবে ঘটা করে নিজের ‘জন্মোৎসব’ করে চলেছেন তিনি [সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার, ১৫ আগস্ট, ২০১২, পৃ. ৩]। জাতির জনকের সপরিবার হত্যাদিবসে তার ‘বানিয়ে তোলা’ এরূপ ‘বে-জন্মদিন’ পালনের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। একটি রাজনৈতিক দল কী পরিমাণ আদর্শবিচ্যুত, নৈতিকতাহীন এবং দেউলিয়াত্বে অন্তসারশূন্য তা ১৫ আগস্টকে মুছে ফেলার এরূপ ষড়যন্ত্র থেকে প্রমাণিত হয় বৈকি! শুরু হয়েছে বাঙালি শোকের মাস আগস্ট। জাতির পিতার হত্যাদিবস, জাতীয় শোকদিবস সামনে।তাই সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বিএনপি নেত্রীকে আমরা অনুরোধ করি একটি ‘মিথ্যা ও বানিয়ে তোলা জন্মদিন’ পালনের জন্য ১৫ আগস্টকে আর কলঙ্কিত করবেন না। আগস্টকে ঘিরে আমরা যারা একটুখানি শোক করতে চাই, একটুখানি ধ্যানিমগ্ন চিত্তে বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করতে চাই একটি ‘বে-জন্মদিন’ পালনের হৈ-হুল্লুড়ে তাদের সেই মৌন-নীরবতা ভেঙে দেবেন না। একদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের শাস্তি না চেয়ে আপনি যেমন কোণঠাঁসা হয়ে আছেন তেমনি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে একটি ‘বে-জন্মদিন’ অর্থাৎ মিথ্যা জন্মদিন পালনের কারণে নবপ্রজ তরুণদের কাছে আপনি ক্রমশ আরো কোণঠাঁসা হবেন। বলা যায় না-  ইতিহাসের আস্তাঁকুড়েও নিক্ষিপ্ত হতে পারেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি যেরূপ নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল ২০১৫ বা তার পরের ১৫ আগস্টগুলোতে বাঙালি কি ততটাই নিদ্রিত থাকবে? এমন যারা ভাবেন তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করেন। বাঙালি এখন চারদিকেই সজাগ। কি ১৫ আগস্ট- কি ২১ আগস্ট, অদম্য বাঙালির বুকে আজ জাগ্রত চেতনা। সেই কালরাতের নিদ্রা আমাদের চোখে আর নেই।  লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এমএস

Advertisement