মতামত

গাজীপুর রাজনীতির ‘ইগো’ ইস্যু না হোক

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলছে। এই লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে যখন তখন হয়তো ভোট গ্রহণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি চলমান নির্বাচন নিয়ে লিখাটা কষ্টকর। কিন্তু গাজীপুর নির্বাচনে ফলাফল যাই-ই হোক না কেন, এই নির্বাচন একটি নতুন তর্ক ও বিতর্কেরহ জন্ম দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

Advertisement

যদিও একটি মাত্র নির্বাচন দিয়ে গোটা নির্বাচন-ব্যবস্থা, রাজনীতি বা সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ খুউব কম, তবুও বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই হচ্ছে নতুন আলোচনা এবং নতুন তর্ক-বিতর্ক, সে আলোকেই এই বিশ্লেষণকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

মাত্র কিছুদিন আগেই খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে। অপরদিকে দেশের কিছু প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউস খুলনা নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে দুর্বল রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে। আর তার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপি দাবি করেছে যে, সরকার বহুবিধ কৌশল অবলম্বন করে প্রশাসনের সহযোগিতায় খুলনা নির্বাচনের ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে।

নির্বাচনে জনগণের ভোট লাভের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব কৌশল অবলম্বণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুলনার ক্ষেত্রে দৃশ্যতঃ কোনো কারচুপি’র প্রমাণ মেলে না। জনগণ ভোট দিতে না পারা, বা একজনের ভোট আরেকজনের দিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে মোটা দাগে নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপ বলে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। খুলনার ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত যে এখনও হয়নি সেটা বলাই বাহুল্য। খুলনায় বিএনপি-প্রার্থী যে পরিমাণ ভোট পেয়েছে তাতে তার পক্ষ থেকে আনা যে কোনো অভিযোগকেই মানুষ অস্বীকার করবে। কিন্তু গাজীপুর নির্বাচনেও বার বার খুলনার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছে বিএনপি নেতৃবৃন্দ, যা দলটির রাজনৈতিক অস্ত্র হলেও মানুষ সেটা খুব ভালোভাবে গ্রহণ করছে বলে মনে হয় না।

Advertisement

গাজীপুর দেশের সবচেয়ে বড় সিটি কর্পোরেশন। ১১ লাখের ওপরে ভোটার রয়েছে এখানে। শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এই সিটি কর্পোরেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এতোদিন যিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি মূলতঃ কোনো কাজ করারই সুযোগ পাননি। সরকারের সহযোগিতা না পাওয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েও তার পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয়নি। ফলে গাজীপুর ঢাকার খুউব কাছে হলেও এই এলাকাটি একেবারেই উন্নয়ন-বঞ্চিত একটি এলাকা হয়ে উঠেছে।

যে কারণে নতুন প্রার্থীদের কাছ থেকে ভোটাররা প্রাথমিক ভাবে একটি প্রতিশ্রুতিই চান যে, কোনো ভাবেই যেনো গাজীপুরকে আর অবহেলা করা না হয়। এই এলাকাটি দিয়ে ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বঙ্গের যোগাযোগ-সড়ক থাকার ফলে এলাকাটি সবসময় যানজটাকীর্ণ হয়ে থাকে। এটিও এই নির্বাচনে একটি প্রধান ইস্যু, কার হাত দিয়ে এই যানজটের সমাধান ঘটবে সেটি প্রার্থী নির্বাচনে বড় নিয়ামক হবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

আমরা জানি যে, এই নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল আরো আগেই। সীমানা সংক্রান্ত এক রিটে নির্বাচনটি স্থগিত হয়ে যায় আবার আদালতের নির্দেশেই যখন নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয় তখন ঈদের ছুটি চলছিলো। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ভোটার তখন গ্রামে ঈদ করার জন্য এলাকার বাইরে অবস্থান করছিলেন। ফলে প্রার্থীদের উৎসাহ ছিল কম।

অপরদিকে প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে একথাটি বার বার শুনতে হয়েছে যে, দুই প্রার্থীর বয়সের ব্যবধান প্রবল। এক প্রার্থী সারাদিন ছুটে বেড়াচ্ছেন এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত কিন্তু আরেকজন প্রার্থী তার বয়সজনিত শারীরিক দুর্বলতার কারণেই প্রচারণায় পিছিয়ে থেকেছেন। গাজীপুরের মতো একটি সদাব্যস্ত এলাকায় একজন কর্মঠ, উদ্যোমী ও দিনভর ক্লান্তিহীন ছুটে চলার মতো প্রার্থী প্রসঙ্গে অনেক ভোটারই খোলামেলা কথা বলেছেন।

Advertisement

প্রশ্ন হলো, সংবিধানে যেহেতু নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট বয়স বা শারীরিক যোগ্যতার কথা বলা নেই সেহেতু এক্ষেত্রে কোনো ভুল হয়নি, তবে সাধারণ মানুষের বিবেচনায় বিষয়টি গুরুত্ব পেলে সেটা রাজনৈতিক দলগুলো কেন বিবেচনায় আনেনি সে প্রশ্নের উত্তর তারাই ভালো দিতে পারবেন।

এমনকি নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রেও বিএনপি’র পক্ষ থেকে খুব একটা আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বার বার খুলনার ধুয়া তুলে বলা হয়েছে যে, সরকার খুলনার কৌশল গাজীপুরেও প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, খুলনার কৌশলটি আসলে কী? সেটি কিন্তু কেউ স্পষ্ট করে বলছে না। কথা হলো, খুলনায় যদি সরকার কোনো কূট-কৌশলের আশ্রয় নিয়েই থাকে তাহলে সেটা বিএনপি ধরে ফেলেছে বলে দাবি করছে। সেক্ষেত্রে গাজীপুরে যদি সরকার সেই একই কৌশল প্রয়োগ করতে চায় সরকার তাহলে সেটা প্রতিহত করাটা বিএনপি’র পক্ষে সহজ হওয়ার কথা। অপরদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বার বার বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগের জবাবে সবকিছু ঠিক আছে বলে দাবি করার বিষয়টিও দৃষ্টিকটূ’।

গাজীপুর নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী যদি পরাজিত হয় তাহলে তাদের পক্ষে একথা বলাটাই সহজ যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, সরকার বিএনপি’র বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে কিংবা নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও একথাটি তারা একবারও বলবে না যে, তারা ১২টি ওয়ার্ডে কমিশনার প্রার্থীও দিতে পারেনি। সেক্ষেত্রে ২৫০০’রও বেশি পোলিং স্টেশনে তারা এজেন্ট দিতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন যখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তোলা হয় তখন সেটা যৌক্তিক শোনায় কারো কারো কাছে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যদি হেরে যায় তাহলে সরকার পরিবর্তন হবে না ঠিকই কিন্তু বিএনপি কি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে স্বীকৃতি দেবে? আমাদের রংপুর বা নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতা কী বলে? সেখানেও কিন্তু অভিযোগের তীর ছোঁড়া হয়েছিল, যদিও সেটা ধোপে টেকেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, স্থানীয় পর্যায়ের এসব নির্বাচন সরকারের ভাগ্য নির্ধারণ না করলেও এসব নির্বাচনের ফলাফলের রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকায় কেউই নির্বাচনে পরাজিত হতে চায় না।

যদি এই গুরত্বকে অবহেলা করে সরকার বা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকে স্বাভাবিক ভাবে অনুষ্ঠিত হতে দিতো তাহলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা যেতো বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। মোটকথা, গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল যাতে কোনো ভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ‘ইগো ইস্যু’ না হয় সেদিকে সকল পক্ষকেই লক্ষ্য রাখতে হবে কারণ তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে গাজীপুরের জনগণ।

গাজীপুর বাংলাদেশের মতোই মোটা দাগে বিভক্ত, অর্থাৎ দু’পক্ষের প্রার্থীরই রয়েছে বিপুল সংখ্যক সমর্থকগোষ্ঠী এবং তারা এলাকা-ভাগে বিভক্তও। ফলে ভাসমান বা সিদ্ধান্তহীন ভোটাররাই হবেন এখানে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক। যে প্রার্থী যতো ভালোভাবে এই এই ভাসমান ভোটারদের নিজের পক্ষে টানতে পারবেন সেই প্রার্থীই বিজয়ী হবেন নির্বাচনে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

আগেই একথা স্পষ্ট করেছি যে, গাজীপুরবাসী আর কিছুই নয়, এলাকার উন্নয়ন চায়, বসবাসযোগ্য একটি সিটি কর্পোরেশন চায়, রাস্তাঘাট চায়, চায় নিরাপত্তা। কে বা কারা তা নিশ্চিত করতে পারবেন সেটা তারা ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এবং সে অনুযায়ী ভোটাধিকারও প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। তবে দু’দিন গাজীপুর চষে বেড়িয়ে একথা স্পষ্টতঃই মনে হয়েছে যে, গাজীপুরবাসী সিদ্ধান্তটি নিয়েই ফেলেছেন ইতোমধ্যে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্টতঃই বলেছেন যে, তিনি সকল পক্ষকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এমনকি প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়েও তিনি বলেছেন যে, নির্বাচন জনগণের, প্রার্থীদের, নির্বাচন কমিশন এখানে শুধু রেফারির ভূমিকা পালন করে থাকে, অতএব সকল পক্ষকেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের দায়িত্বটি নিতে হবে।

গণমাধ্যমের কড়া নজরদারির কথাটি তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। খুলনার যতোটুকু অনিয়ম তা জনগণের সামনে তুলে ধরার পুরো কৃতিত্ব গণমাধ্যমের। গাজীপুরেও গণমাধ্যম সজাগ দৃষ্টি রাখবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো, সচেতন মানুষের সংখ্যাও এখন আর কম নয়। সকলেই সজাগ থেকে গাজীপুরে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করা যায় কারণ এখনও পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো গণ্ডগোলের খবর পাওয়া যায়নি।

এতোদিন নির্বাচনের সঙ্গে রক্তপাতের একটি বড় যোগসূত্র দেখা গেছে, কিন্তু খুলনাতেও তা আমরা দেখিনি, যা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং গাজীপুরেও সেরকম কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি এখনও পর্যন্ত। বাংলাদেশের মতো উঠতি গণতন্ত্রের দেশে এও এক ধরনের অর্জন বটে।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও একটি পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে বলে মনে করা যায়। গাজীপুর নির্বাচনের পর আমরা তার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাবো সকল পক্ষের কাছ থেকে, এই আশাবাদও রাখতে চাই। তবে শুরুতেই বলেছি যে, একটি মাত্র নির্বাচন দিয়ে গোটা সিস্টেমের অবস্থা বোঝার সুযোগ নেই। তবুও গাজীপুর নির্বাচন দেখে বিএনপি ভবিষ্যতের নির্বাচন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা মোটেও বড় রাজনৈতিক দলের বক্তব্য হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়।

মাগুরা বা ঢাকা-৮ আসনের নির্বাচনের মতো ভয়াবহ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আর এদেশে ঘটবে না, এটাই বাস্তবতা। জনগণই সেটা হতে দেবে না। জন-শক্তির ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ফিরে এলেই কেবল দেশটির গণতন্ত্র রাহুমুক্ত হবে- গাজীপুর নির্বাচনও আমাদের সেই বার্তাই দেবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/জেআইএম