দেশজুড়ে

পদ্মায় লঞ্চডুবির এক বছর আজ : থেমে নেই স্বজন হারানোদের কান্না

উত্তাল পদ্মা। এর মাঝে চলছে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চ । আর সেই খাম-খেয়ালির বলি হয়ে পদ্মায় সলিল সমাধি হতে হয় আড়াই শতাধিক যাত্রীকে। গত বছর এই দিনে (৪ আগস্ট) কাওরাকান্দি ঘাট থেকে মাওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা পিনাক-৬ লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে পদ্মার বুকে তলিয়ে যায়। কাওড়াকান্দি-মাওয়া (বর্তমান শিমুলিয়া নৌরুটের) মুন্সীগঞ্জের পদ্মায় পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবির এক বছর আজ। এ কারণে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের কান্নার রোল থেমে নেই।নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সরকারিভাবে ৪৯ যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হলেও কার্যত দুই শতাধিক যাত্রীর খোঁজ আজও মেলেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি স্বজনহারা পরিবারের খোঁজটুকুও। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বুকের ধন অতি আদরের সন্তান হারিয়ে অনেক অসহায় পরিবারকে কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন যাপন। নিহতের পরিবার পূর্ব নির্ধারিত সাহায্য পেলেও নিখোঁজদের স্বজনরা কোনো সান্ত্বনা পর্যন্ত পাননি। যে সকল পরিবারে এখনো স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকাি সাহায্য। এরপর আর কেউই তাদের খোঁজ নেয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি নিখোঁজদের উদ্ধারে কোনো কার্যক্রম।তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগে জানা যায়, এখনো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়েই অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে নৌযান। এদিকে বিশেষ নজর দাবি করছেন সাধারণ যাত্রীরা।অন্যদিকে গত বছরের সেই পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবির আতংক এ বছরও কাটেনি। এ বছর প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দাবি কর্ত্তৃপক্ষের। তাই এই বছর বর্ষা মৌসুমে ঈদ হওয়ায় দুর্ঘটনার ভয়ে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা লঞ্চের পরিবর্তে ফেরিতে বেশি পার হয়েছেন।গত রমজানের ঈদের পর ৪ আগস্ট ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাদারীপুরের কাওরাকান্দি ঘাট থেকে মাওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা পিনাক-৬ নামে লঞ্চটি পদ্মার বুকে তলিয়ে যায়। সরকারিভাবে ওই ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর মরেদহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২৮টি মরদেহ তাদের পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয় আর ২১ জনের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় শিবচর পৌরকবর স্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।নিখোঁজ থাকে আরো ৫৩ জন। অন্যদের হদিস আজও মেলেনি। তবে বেসরকারি হিসেব মতে এখনো নিখোঁজ রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক যাত্রী। স্বজনদের না পেয়ে এসব পরিবারে চলছে এখনো শোকের ছায়া।পারিবারিক সূত্র জানায়, লঞ্চ দুর্ঘটনায় শিবচর পৌর এলাকার মো. নুরুল হক মিয়ার শিকদার মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ে নুসরাত জাহান হিরা ও রাজধানীর বীরশ্রেষ্ট নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা এবং তারই ভায়রার মেয়ে চীনের জইনুস মেডিকেল কলেজের ছাত্রী শরিয়তপুরে গঙ্গানগর এলাকার জান্নাতুল নাঈম লাখি এই দুর্ঘটনায় মারা গেলেও উদ্ধার হয়েছে দুইজনের মৃতদেহ। একজন এখনো নিখোঁজ।এছাড়া শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধা রিজিয়া বেগমের এক ছেলে মিজানুর রহমান, পুত্রবধূ রোকসানা বেগম, আড়াই বছর বয়সের নাতি মাহিন এবং এগার বছর বয়সের নাতনি মিলিসহ একই পরিবারের চারজন নিহত হন। গত বছরের লঞ্চডুবিতে একই চারজনকে হারিয়ে ওই পরিবারের কর্তা বৃদ্ধ নুরুল ইসলাম তার ছেলে, পুত্রবধু ও নাতি নাতনির শোকে গত কিছুদিন আগে মারা গেছেন।এতে ক্ষোভের অন্ত নেই স্বজনহারা রিজিয়া বেগম ও নুরুল হক এই দুটি পরিবারে। শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের নিহত মিজানুরের মা রিজিয়া বেগম  জানান, তার বড় সন্তান মিজানুর রহমান ও নাতি নাতনিদের হারিয়ে পাগল প্রায়। এখনো সন্তানদের আশায় বুক বেধে আছি। শোকে শোকে আর দিন কাটছে না এ শোকের কারণে আমার স্বামী মারা গেছে।নিহত স্বর্ণা ও হিরার বাবা নুরুল হক জানান, ওদের কথা সব সময়ইতো মনে পড়ে।  এ ব্যাপারে অনেকে তো মাঝে মধ্যে স্মরণ করে। কিন্ত আমরা বাবা-মা কখনোই ভুলতে পারি না। ওদের মনে পড়ে সব সময়ই।  শুধু এই পরিবারই নয়। এরকম আরো অর্ধশত পরিবারে এখনো শোকের মাতম। আর যেন এ ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটে সে জন্য প্রশাসনের কড়া নজরদারির দাবি স্বজন হারোনো পরিবারের সদস্যদের।মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন বিশ্বাস জানান, এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে উদ্ধার হওয়া ২৮ মৃতদের মধ্যে ২৭টি পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। তবে নিখোঁজ যাত্রীদের পরিবার আবেদন করলে ক্ষতিপূরণ দেয়ারও আশ্বাস দেন।নাসিরুল হক/বিএ

Advertisement