বিশেষ প্রতিবেদন

পুলিশকে গুলি ছুড়ে পালাতে থাকে ‘দুই খুনি’

ঈদের আগের দিন (১৫ জুন, শুক্রবার) জুমার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতেই দুজন যুবকের টার্গেটে পড়েন আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ আলী (৫৪)। উত্তর বাড্ডার আলীর মোড় এলাকার পূর্বাঞ্চল-১ নম্বর লেন সংলগ্ন বায়তুস সালাম জামে মসজিদের সামনে ফরহাদকে চারটি গুলি ছুড়ে পালিয়ে গুলশান গুদারাঘাটের রাস্তা ধরেন ওই দুই যুবক। গুদারাঘাট চেকপোস্টে পুলিশের ওপরও গুলি ছোড়েন তারা।

Advertisement

পুলিশ সদস্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুদারাঘাট চেকপোস্ট পেরিয়ে ডেসকো ভবনের পেছন দিয়ে তারা মিশে যান মানুষের মাঝে। পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে তাদের পালানোর সেই চিত্র। ভিডিও ফুটেজের একটি কপি জাগো নিউজের হাতেও এসেছে।

বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলী হত্যায় এই ভিডিও ফুটেজের দুই যুবকই জড়িত বলে মোটামুটি নিশ্চিত তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও পরিচয়ও নিশ্চিত হয়েছেন তারা। এই দুই যুবকের নাম হলো- মেরাজুল ইসলাম ও জুয়েল মিয়া ওরফে খ্রিষ্টান জুয়েল।

গুদারাঘাটের ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরায় (সিসিটিভি) ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে খুনিদের নামতে বলেন পোশাকধারী এক পুলিশ সদস্য। তাদের পেছনেই বন্দুক হাতে দুই আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ (এপিবিএন) সদস্য। সিএনজি থেকে প্রথমে নামেন মিরাজুল পরে জুয়েল। জুয়েলকে তল্লাশি শুরু করার সুযোগে মেরাজুল মোবাইল চেপে হেঁটে এগিয়ে যান।

Advertisement

পেছন থেকে এপিবিএন সদস্য ডাক দিলে ফুটপাতে হাঁটতে থাকা মেরাজুল ফের কাছাকাছি চলে আসেন। ইস্পাতে গড়া ফুটপাতের ওপরের একটি ছাতার নিচ দাঁড়িয়ে আকস্মিকভাবে কোমর থেকে পিস্তল বের করে পুলিশ সদস্যদের দিতে তাক করেন। মাত্র ১৫ থেকে ২০ গজ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যরা ভড়কে যান। পিছিয়ে যান তারা। এ সময় (গত শুক্রবার দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে) মেরাজুল দুটি ফাঁকা গুলিও ছোড়েন। মেরাজুলকে অনুসরণ করে সিএনজিতে রাখা অস্ত্র নিয়ে জুয়েলও দৌড় দেন। এ সময় বসে পড়েন দুই পুলিশ সদস্য। এক এপিবিএন সদস্যকে অস্ত্রের ট্রিগার টানতে দেখা যায়। পালিয়ে যাবার পর পোশাকধারী পুলিশকে ওয়্যারলেসসেটে কথাও বলতে দেখা যায়। জুয়েলের পরনে ছিল সাদা টি-শার্ট। আর মেরাজুল ইসলামের গায়ে লাল টি-শার্ট।

গত শুক্রবার গুলিবিদ্ধ ফরহাদ আলীকে স্থানীয় মুসুল্লিদের সহযোগিতায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ফরহাদ আলীর মরদেহের সুরতহাল করা বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহীদুল ইসলাম জানান, ফরহাদের ডান গালে একটি, বাঁ চোখ বরাবর একটি, মাথার ওপরে বাঁ দিকে একটি এবং ঘাড়ের বাঁ দিকে মোট চারটি গুলির আঘাত রয়েছে।

ঘটনার চারদিন পর নিহত ফরহাদ আলীর স্ত্রী মুর্শিদা বেগম হত্যা মামলা করেন। নথিভুক্ত মামলার নং ২৯। ধারা- ৩০২, ১০৯/৩৪ পেনাল কোড। দুলাল, বিপ্লব, রহিম, কামরুল এই চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলায় অজ্ঞাত আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।

Advertisement

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফরহাদ খুনের নেপথ্যে ছিল বাড্ডা এলাকার ডিশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন চাঁদাবাজি ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জের।

তার বিরুদ্ধে অন্য পক্ষের চলছিল দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ ও বৈরি সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদের একচ্ছত্র চাঁদাবাজি ও ডিশ ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ বন্ধেই এই ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করা হয়। পেশাদার খুনি হিসেবে পরিচিত মেরাজুল ইসলাম ও জুয়েল মিয়ার বিরুদ্ধে এর আগেও হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ফরহাদ খুনের পরপরই দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন মেরাজুল ইসলাম ও জুয়েল।

তিনি জানান, তারা প্রথমে বাড্ডা লিংক রোডে এসে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়েন। দক্ষিণ বাড্ডার গলিপথ দিয়ে গুদারাঘাটে সড়কে ওঠেন। তারা হাতিরঝিল দিয়ে না ঢুকে গুলশান-১ এর দিকে যেতেই পুলিশের চেকপোস্টে আটকা পড়েন। ১টা ৫৩ মিনিট ১৩ সেকেন্ড সময়ে এক পুলিশ সদস্য তাদের নামতে বলেন তল্লাশির জন্য।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘গুদারাঘাটে আমাদের স্থায়ী চেকপোস্ট। ওই সময় একজন এএসআইয়ের (সহকারী উপ-পরিদর্শক) নেতৃত্বে চারজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। বাড্ডার খুনের ঘটনাটি জানা ছিল না। থাকলে হয়তো আরও সতর্কাবস্থায় থেকে অস্ত্রধারীদের গুদারাঘাটেই আটক করা সম্ভব ছিল। তবে পুলিশের ওপর গুলি ছুড়ে পালিয়ে যাবার ঘটনাও আকস্মিক।

ডিএমপির বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার আশরাফুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ফরহাদ আলীকে গুলি করে হত্যায় জড়িত দুই যুবককে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজে। ওই দুই যুবকই গুদারাঘাটে পুলিশ চেকপোস্টে গুলি ছুড়ে পালিয়ে গেছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি। মামলাটি এখন তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। এ মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ডিবি পুলিশ বলতে পারবে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ফরহাদ হত্যা মামলাটি তদন্ত করছি। ওই ঘটনায় জড়িত দুই যুবক পেশাদার খুনি। তারা এর আগেও ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করেছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। গভীর তদন্ত চলছে। খুব শিগরির মামলার আসামি গ্রেফতারে অগ্রগতি জানতে পারবেন।

জেইউ/জেডএ/আরআইপি