বিনোদন

পোড়ামন ২ : চেনা গল্পের ট্রাজেডিতে মুগ্ধতার নির্মাণ

আহামরি কিছু নয়। শ্বাশত প্রেমের গল্প। যুবক-যুবতীর প্রেম নিয়ে হাহাকার। তবে মনে দাগ কেটে যায়। শেষ পর্যন্ত দেখার আগ্রহে বসিয়ে রাখে। সিনেমা হিসেবে এটুকুকেই বিশেষ প্রাপ্তি বলা যেতে পারে। আর বিয়োগান্তক প্রেমের গল্প এখনো মানুষ পছন্দ করেন এটাই নতুন করে আরেকবার প্রমাণ করলো ‘পোড়ামন ২’।

Advertisement

মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহেও দর্শক পাচ্ছে ‘পোড়ামন ২’। এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ের হিসেবে হল কম নিয়েও এগিয়ে ছবিটি। শুক্রবার বলকা সিনেমা হলের সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার শোতেও দেখা গেল দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। লাইন দিয়ে টিকিট কেটে এখনো দর্শক দেখছেন ছবিটি। মন্দার সিনেমার বাজারে এটা আশা জাগানিয়া দৃশ্য।

প্রখ্যাত লেখক শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও জুলিয়েট’ যারা পড়েছেন তারা জানেন গল্পের নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ, একজন অপরজনকে না পাওয়ার কষ্টে আত্মহত্যার কাহিনী, মন কতোটা ছুঁয়ে দিতে পারে। রোমিও জুলিয়েট ভালোবাসার গল্পের এক ধারা। এই পথে পা রেখেই তৈরি হয়েছে অনেক অনেক গল্প-সিনেমা। সফলতার মুখ দেখেছে বেশিরভাগ। সেই রাস্তায় হেঁটেই তৈরি হয়েছে মৌলিক গল্পের নতুন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ‘পোড়ামন ২’।

ছবিটি দেখতে যাবার আগে মনে মনে ভাবছিলাম ‘পোড়ামন ২’ কোন ঘরানার সিনেমা? ছবি দেখে সহজ করে বলতে পারছি বিয়োগান্তক প্রেমের গল্পের সিনেমা এটি। রায়হান রাফি পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘পোড়ামন ২’। এই সিনেমা বিভিন্ন চরিত্র ও কলাকুশলীরা হলেন সিয়াম আহমেদ (সুজন শাহ), পুজা চেরি (পরী তালুকদার), বাপ্পারাজ (নওশের/সুজনের ভাই), ফজলুর রহমান বাবু (কাফিল মিয়া), সাঈদ বাবু (মোকছেদ তালুকদার), আনোয়ারা বেগম (পরীর দাদী), নাদের চৌধুরী (বদরুল তালুকদার), রেবেকা রউফ (পরীর মা), পিয়াল আহমেদ, চিকন আলী প্রমুখ।

Advertisement

দুই জন তরুণ তরুণীর নিছক প্রেমের গল্প নিয়ে তৈরি হয়নি সিনেমাটি। সমাজের নানা বাস্তবতা উঠে এসেছে এতে। গ্রামের শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রথম শিক্ষাঙ্গন মক্তবের গল্প, গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে দিনমজুরদের অপমানিত ও লাঞ্চিত হওয়ার গল্প। নিখুঁতভাবে সেইসব প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হয়েছে একটি প্রেমের গল্প। ২০১৩ সালের সুপারহিট মুভি ‘পোড়ামন’র সিক্যুয়েল এই ছবিটি। তাই সিনেমার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পোড়ামন ২’।

না, সিনেমার গল্প এখানে না। রুপালী পর্দাতেই দেখতে হবে। তবে কিছু বিষয় তুলে না ধরলেই নয়। পোড়ামন ২ এর গল্প, সংলাপ ও চিত্রনাট্য বেশ পরিচ্ছন্ন। ছবির শুরুতে দেখা যায় একটা লাশ ঝুলে আছে গাছে। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে আত্মহত্যা করেছেন কফিল মিয়ার মেয়ে। কফিল চরিত্রে অভিনয় করে শুরুতেই দর্শকদের কাঁদিয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু। আত্মহত্যা করায় গ্রামের মৌলভি ও মানুষদের তোপের মুখে পড়তে হয় কফিলকে। এই তরুণী ও তার বাবার করুণ পরিণতির গল্প দর্শক মনে হাহাকারের জন্ম দেবে।

ঠিক সেই সময় নায়ক সিয়ামের আগমন ঘটে। হাত তালিতে ভরে যায় হল। পুরো সিনেমাতেই সিয়ামের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক। এক কথায় প্রথম সিনেমাতেই দর্শকের মন কাড়তে পেরেছেন এই অভিনেতা। মজার ব্যাপার হলো সিনেমার চরিত্রটিতেও সে নিজেকে নায়ক বলে দাবি করে। অনেক বড় নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। সালমান শাহ’র একনিষ্ট ভক্ত সুজন। সালমানকে গুরু মানে। মাঝে মধ্যে নাকি গুরুর সঙ্গে দেখাও হয় তার; স্বপ্নে।

তবে সিয়ামের আঞ্চলিক ভাষায় কিছু সমস্যা হয়েছে। গ্রামের একটি ছেলে নায়ক হতে চায়, সে কিছুটা শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা করতেই পারে। সেদিক থেকে ধরলে উতরে গেছেন সিয়াম। অনেকেই ঢাকাই সিনেমার নতুন সম্ভাবনা মনে করছে সিয়ামকে। সেই ভরসা করা যেতে পারে।

Advertisement

নায়িকা হিসেবে পূজাও মুগ্ধতা ছড়াতে সক্ষম হয়েছেন। এটি দ্বিতীয় সিনেমা পূজার। এর আগে তার ‘নূরজাহান’ সিনেমায় কান্নার দৃশ্য ও অভিনয়ে যেসব দুর্বলতা চোখে পড়েছে তা প্রায়ই কাটিয়ে উঠেছেন পূজা। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সামনে আরও ভালো করবেন পূজা।

সিনেমার খল অভিনেতার ভূমিকায় ছিলেন নাদের চৌধূরী এবং সাঈদ বাবু। নাদের চৌধুরী অভিনয়ে ভনিতা ছিল। তবে নজর কাড়ার মতো অভিনয় করেছেন সাঈদ বাবু। মোকছেদ তালুকদারের চরিত্রে অভিনয় করে মাতিয়ে দিয়েছেন তিনি। সাঈদ বাবুর সংলাপ ‘ভাল্লাগছে, খুব ভাল্লাগছে’ দর্শকের মনে গেঁথে গেছে। এটি আলাদা করে জনপ্রিয়তাও পেয়েছে বেশ। ছবিতে তার আগুন মুর্তি ছিলো দেখার মতো।

বাপ্পারাজকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি যে জাত অভিনেতা সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন আরও একবার। নায়ক সুজন শাহ’র বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। একজন বড় ভাই তার ছোট ভাইয়ের জন্য কী করতে পারেন সেই ত্যাগ দেখানো হয়েছে এই চরিত্রটির মাধ্যমে। গ্রামের সহজ-সরল নওশেরের চরিত্রে একদম মিশে গিয়েছিলেন বাপ্পা। তার জন্য শ্রদ্ধা।

আনোয়ারা বেগম, রেবেকা রউফ নিজ নিজ চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন। সিনেমার একটা অংশ জুড়ে ছিল কমেডি দৃশ্য। চিকন আলী ও পিয়াল আহমেদের কমেডিটা এসেছে গতানুগতিক ধারায়। মন্দ না, তবে মনে রাখার মতো কিছু নেই এখানে। হয় তো কষ্টের গল্পের ভেতর সস্তা হয়ে গেছে কমেডিটা।

ছবির সিনেমাটোগ্রাফি হয়েছে দেখার মতো। গ্রামের নান্দিক দৃশ্যগুলো দারুণ সব অ্যাঙ্গেলে ফুটে উঠেছে পর্দায়। এডিটিং এবং কালার গ্রেডিং কাজও ভালো হয়েছে। তবে ছবির শুরুর কিছু অংশে যে ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয়, সেখানে স্ক্রিন অনেক বেশি ঘোলা ছিল। আরেকটু ভালো করা যেতো। ছবির লোকেশন ছিল দুর্দান্ত। প্রথমবারের মতো মেহেরপুরে কোনো ছবির শ্যুটিং হলো। সবগুলো লোকেশনই বেশ সুন্দর ছিল। ছবির গানগুলোর কোরিওগ্রাফি বেশ ভালো হয়েছে। পুজা চেরি অনেক সুন্দর নেচেছেন। সিয়ামের নাচে একটু দূর্বলতা রয়েছে। তবে অভিনয় খুব ভালো করেছেন সিয়াম।

ছবিতে মোট ৬ টি গান রয়েছে। সবগুলো গানই শ্রুতিমধুর। গানগুলোর কোরিওগ্রাফি ছিলো উপভোগ করার মতো। তবে একটি অভিযোগ করা যেতে পারে ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার নামে। সেটি হলো, ধীরে ধীরে কলকাতাপ্রীতি ছেড়ে দেশীয় প্রতিভা-মেধায় যেন ভরসা করতে শেখে প্রতিষ্ঠানটি। সিনেমার গানের জন্য কলকাতার আকাশ সেনের খুব বেশি ভরসা করে জাজ। কিন্তু শ্রুতি মধুর গানের দোহাই দিয়ে অনুকরণীয় সুর-তাল ছাড়া তিনি আর কিছুই দিতে পারেননি এই কয়েক বছরে বাংলাদেশি ইন্ডাস্ট্রিকে। ‘পোড়ামন ২’ ছবিটিতেও তেমন বিশেষ কিছু প্রাপ্তি নেই তার। বরং দেশের সুপারহিট অমর নায়কের গানটি বাংলাদেশের কলাকুশলীরা করলেই ভালো হতে বলে মনে হয়। আর দেশের বাইরের কাউকে যদি নিতেই হয় সেটা যেন হয় নচিকেতা, কবীর সুমন বা অনুমপ রায়দের মতো সেরা কেউ। যাদের সংযুক্তি নিয়ে গল্প করা যায়, বিনোদিত হওয়া যায়।

এবার আসা যাক অলটাইম নিবেদিত ছবিটির নির্মাণ ও নির্মাতা প্রসঙ্গে। একজন নির্মাতার প্রথম সিনেমা হিসেবে কিছু ভুলত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিক না। রায়হান রাফি হয়তো নিজেই বুঝবেন সেগুলো। শুধরেও নেবেন। মুখ্য বিষয় সেটি নয়। নির্মাতা হিসেবে পুরো ছবিতেই একের পর এক চমক দেখিয়েছেন তিনি। সিনেমার মেদ বাড়াননি অযথা। হঠাৎ করেই দৃশ্যের মধ্যে গান ঢুকে পড়েনি। নায়কের মৃত্যু হয়েছে ভেবে সবার যখন মন খারাপ। তখন গল্পের মোড় ঘুরে গেছে। ছবির শেষ না দেখলে বোঝার উপায় নেই শেষে কী অপেক্ষা করছে।

রাফির সার্থকতা এখানেই তার নির্মিত প্রথম ছবিটিই গ্রহণ করেছেন দর্শক। দর্শকের চোখে পানি নিয়ে আসাটা খুব সহজ কাজ না। জোর করে দর্শককে হাসানো তার চেয়ে হয়তো সহজ। বোকা বোকা অভিনয় দেখে এমনিতেই মানুষ হাসে। কিন্তু রাফি সুনিপুণভাবেই দর্শকের ভেতরে হাহাকার ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। অপেক্ষা করা যাক আরও একটা ভালো ছবির জন্য।

এমএবি/এলএ/আরআইপি