মতামত

৭০ বছরে আওয়ামী লীগ ও আগামীর প্রত্যাশা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু সর্ববৃহৎ, প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলই নয় এটা মানুষের আবেগ অনুভূতির পাওয়ার জায়গা। ইতিহাসের পরতে পরতে যার সুর সাধনা। গণতন্ত্র থেকে উন্নয়ন তারই সৃষ্টি। নির্যাতিত নিপীড়িত শোষিত মানুষের প্রত্যাশার ফসল হিসেবে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

Advertisement

জন্মলগ্ন থেকেই প্রত্যাশা আকাঙ্খা পূরণে দলটি বদ্ধপরিকর। শত ঘাত প্রতিঘাত ধাপে ধাপে মোকাবেলা করেছে। আবেগী হয়েছে অভিমানী হয়েছে কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণে থেমে থাকেনি এক মুহূর্ত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয়েছিল মিশনের পর মিশন। দল আর এই মিশনের একমাত্র অক্সিজেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৭ সালে যে আশায় ব্রিটিশ শাসনকে বিদায় জানানো হয়েছিল সেই আশা বাস্তবায়নে বাদ সাজে কুখ্যাত পাকিস্তানীরা। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু করেছিল নিষ্পেষিত মানুষের প্রত্যাশা পূরণের পথ চলা। ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল বটে কিন্তু কাজের কাজ হতে দেয়নি পাকিস্তানীরা। তাই জনগণের চাওয়া পাওয়াকে আশ্রয় দিয়ে ৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৬২’র আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৪’র দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ক্রমেই আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিল বাংলার জনগণের অধিকার দায়ের প্রাণ শক্তি।

প্রাণের অস্তিত্বকে খোঁজার জন্য বাস্তবায়নের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল বাঁচা-মরার মুক্তির সনদ ১৯৬৬’র ৬ দফা। মানুষের প্রত্যাশা ঘর থেকে বেড়িয়ে যুক্ত হয়েছিল ছয় দফায়। প্রত্যাশা পূরণের হাতিয়ার যখন ষড়যন্ত্রের শিকার। সেই ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ভেঙে ১৯৬৯’র দুর্বার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্ত করেছিল জাতির পিতাকে। জাতি ছিনিয়ে এনেছিল ১৯৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয়।

Advertisement

বিশ্বে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যারা কিনা একটি জাতির ভাষার জন্য, পতাকা নিজেদের করে পাওয়ার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ মানুষের এমনই এক আশা-ভরসা আর আস্থার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে কোন কুণ্ঠাবোধ করেননি। যার ফলে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। তাই তো আওয়ামী লীগের কাছে বরাবরই মানুষের প্রত্যাশা অনেক অনেক বেশি।

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই জনগণের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়েই আওয়ামী লীগের অদম্য ছুটে চলা। স্বাধীনতার পর সাড়ে সাত কোটি সন্তানের প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দেশটিকে। ভুখা জনগণের পেটে দু'বেলা দু মুঠো ভাত তুলে দেওয়াসহ মৌলিক অধিকার ও প্রত্যাশা পূরণে শতভাগ সফলতার দাবিদার বঙ্গবন্ধু।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের সংগ্রামে নিজেকে লিপ্ত করে বঙ্গবন্ধু যখন দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ঠিক এমন এক অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশী বিদেশী অপশক্তির ষড়যন্ত্রে সংগঠিত হয় বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্রাজেডি ১৫ই আগষ্টের ঘৃণিত হত্যাকান্ড। ১৫ই আগস্টের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত পরিণত হয় পাকিস্তানের নব্য সংস্করণে।

প্রত্যাবর্তন ঘটে পাকিস্তানি আমলের চরম সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল, সেনা আমলা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ধারা। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নির্বাসিত হয়। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগকে চরম বৈরী ও বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে নিপতীত করে।

Advertisement

জাতির পিতাকে হারানোর সাথে সাথে জাতি হারিয়ে ছিল জাতীয় চার নেতাকে। খুনি মেজর জিয়া, মোশতাকরা জাতির প্রত্যাশা পূরণের অক্সিজেনকে হত্যার মাধ্যমে চিরবিদায় করতে পারলেও প্রত্যাশাকে থেমে রাখতে পারেনি। বিদেশে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাদের ওপর তখন চলছিল জিয়ার অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। অনিরাপদ জেনেও জাতির প্রত্যাশা পুরণের হাল ধরতে প্রাণভয় তুচ্ছ করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ছুটে আসেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা সমগ্র বাংলার প্রত্যাশার কান্ডারি শেখ হাসিনা।

জাতীয় রাজনীতির অগ্রভাগে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা জাতির জনকের আদর্শকে ধারণ করে জাতির উন্নয়নধারাকে একচ্ছত্র নেতৃত্বে অবিরাম এগিয়ে নিয়ে চলছে। সংগ্রামের এ অধ্যায়ের নায়ক বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।

চারিদিকে ওঁৎ পেতে থাকা মৃত্যু আর হত্যা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে হাল ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। পিতা হারানো দিশেহারা জাতির মাথার উপর ছাতা হয়ে এলেন শেখ হাসিনা। দেশবাসীর মনে সঞ্চার হলো নতুন আশার। নতুন প্রত্যাশার। সে প্রত্যাশার মান রাখতে একজন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন করে সংগ্রাম শুরু করলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

ভোট ও ভাতের অধিকার সেই সাথে বঞ্চিত জাতির স্বীয় অধিকার ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর শেখ হাসিনার সংগ্রাম আর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দেশবাসীর ভালবাসা নিয়ে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তাদের প্রত্যাশার জবাব স্বরুপ বাংলার শাসন ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ শুরু করলেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ বিরোধময় পার্বত্য শান্তিচুক্তি, বেকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রিলিফ-ভিজিএফসহ বিভিন্ন ভাতা চালু, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার ও স্বাক্ষরতার হার বাড়ানোসহ এক এক করে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাচ্ছিলেন তিনি।

২০০১ সালের নির্বাচনে স্বাধীনতার দোসর জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট বাঁধা ক্যান্টনমেন্ট এর আস্তাকুঁড় থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি সরকার এসে সাময়িক ব্যহত করে প্রত্যাশা পূরণের এ অগ্রযাত্রা। জঙ্গিবাদ বিস্তার হতে থাকে দেশে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার মত বড় বড় জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা করেছিল তারা। এমন অবস্থা থেকেও দেশবাসীর উত্তরণের পথ দেখাতে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ।

এবারের প্রত্যাশাগুলো শুধু প্রত্যাশাই নয়। চ্যালেঞ্জও বটে। শক্ত হাতে জঙ্গি দমন, জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের বিচার ও সাজা কার্যকর করা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা ও জীবন যাত্রার মান বাড়িয়ে এবারো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাশার জবাব দিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালে আবারো জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় এসে কাজ শুরু করলেন জনগনের প্রত্যাশা পূরণে। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল যুগের সাথে, সময়ের সাথে নিজেকে গতিশীল করা। সেই প্রত্যাশাকে মনে ধারণ করে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর মত স্বপ্নীল প্রকল্প, চাকরিজীবীদের দ্বিগুণ বেতন বৃদ্ধি, বিভিন্ন ই-সেবা চালু করে দেশকে ডিজিটালাইজড করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় মুক্তির প্রত্যাশা সুষ্ঠু, সুন্দর জঙ্গীবাদ মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ, তাও সফল হাতেই বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে তথা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা হলো দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, জঙ্গি, মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের মাধ্যমে দেশ হবে উন্নত বিশ্বের কাতারে দাঁড়ানো একটি সুন্দর বাংলাদেশ। এটি বাস্তবায়ন করার জন্য একটি বিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ এর প্রয়োজন। যে আওয়ামী লীগে থাকবে না অন্যদল থেকে আসা হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী আর ত্যাগী কর্মীদের রক্ত চোষা জোঁক। এটা একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আপনি শতভাগ সফল হলেও আপনার কাছে তৃণমূলের লক্ষ লক্ষ আবেগেই এই প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন জনগণের মুক্তি, আকাঙ্ক্ষা এবং অধিকার আদায়ের ঘাঁটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

লেখক : শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

এইচআর/এমএস