মতামত

সমঝোতা আছে তবু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিষ্প্রভ

 

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতনের তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আগামী ২০ জুন নেদারল্যান্ডসে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসবে। আসন্ন ঐ বৈঠকে রাখাইনে সংগঠিত জাতিগত নিধন তথা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, বাস্তুচ্যুত ও ধর্ষণসহ মানবতা বিরোধী অপরাধ বিষয়ে তদন্ত শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা রয়েছে।

Advertisement

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১১ জুনের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ চেয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ তার পর্যবেক্ষণ তথা এ সংক্রান্ত তথ্যাদি জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এতদ্বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন ‘আমরা আইসিসির অনুরোধে সাড়া দিয়েছি। তারা যেসব তথ্য চেয়েছে, সেগুলো দিয়েছি এবং অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যা জানি তাও জানিয়েছি।’ আইসিসির সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, রোহিঙ্গা নির্যাতনের তদন্ত শুরুর জন্য এর মধ্যেই অন্তত চারটি আলাদা আবেদন জমা পড়েছে। তার মধ্যে প্রবাসী রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠনের আবেদনও আছে। এ ক্ষেত্রে বিচারের এখতিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ আদালতের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে এখন নেদারল্যান্ডসের দিকে তাকিয়ে উন্মুখ হয়ে আছি।

এদিকে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এযাৎকালের সর্বশেষ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে বিগত ৬ জুন মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে। এই চুক্তি তথা সমঝোতাটি স্বাক্ষরিত হয়েছে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে। অনেক জল ঘোলা করার পর মিয়ানমার এই চুক্তিতে শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার একেবারে শুরু থেকেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তি চেয়ে আসছিল। জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের একটি প্রত্যাশা বা দাবি পূরণ হলো। কী আছে এই সমঝোতার ভেতর মহলে তা আমরা এখনো অবগত হতে পারি নি; তবু প্রত্যাশা বা দাবি পূরণ তথা চুক্তি বা সমঝোতা স্বাক্ষরের এই কাগুজে ঘটনায় আমরাও আপাতভাবে খুশি- একথা বলা যায় খানিকটা নির্দ্ধিধায়। কারণ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নিয়ে সৃষ্ট সংকট ঘিরে এ পর্যন্ত অনেকগুলো চুক্তি বা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হলেও মিয়ানমার কিন্তু চুক্তির আলোকে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের উদ্যোগ বা কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে বলে আমাদের জানা নেই।

আমরা বরং এ কথাই অধিক জানি যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব চুক্তি বা সমঝোতায় ইতোপূর্বে সম্মত হয়েছিল বলে উভয় দেশের মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের একাধিক সফর, আলোচনা এবং শেষ পর্যন্ত সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর পর্যন্ত গড়িয়েছে তার কোনোটিই তেমন কাজে আসেনি। অর্থাৎ এ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা স্মারক তার কাগুজে অবয়ব থেকে বাস্তব রূপে পরিণত হতে পারে নি। তাই আমাদের দিক থেকে জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের উপরোক্ত চুক্তিতে খুশি বা উল্লসিত হওয়ায় এক ধরনের মানসিক স্থবিরতা কাজ করে বৈকি, কাজ করে বিশ্বাস করার অভাববোধও। তাই জাতিসংঘের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সর্বশেষ সম্পাদিত চুক্তি নিয়েও আমাদের মধ্যে উত্তেজনা কম। আশা বা প্রত্যাশাও কম। একেবারেই কম!

Advertisement

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘জাতিগত নিধন’ পুনরায় শুরু হলে গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এদেশে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সাময়িকভাবে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও মিয়ানমারের দিক থেকে বিগত এক বছরে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে নানারূপ টালবাহানার আশ্রয় নিয়েই চলেছে।

পূর্বেকার থেকে যাওয়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা ব্যতিরেকে নতুন করে অনুপ্রবেশের ফলে সাড়ে সাত লাখসহ বারো লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য কত বড় একটা চাপ তা কেবল বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষেই উপলব্ধি সম্ভব। আর রোহিঙ্গাদের মানবিক জীবনের দুর্দশা? রোহিঙ্গাদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন আশ্রয় শিবির এলাকায় না গেলে কোনোভাবেই উপলব্ধি সম্ভব নয়।

মিয়ানমারের উগ্রপন্থি বৌদ্ধ সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা রকমের উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে চলেছে। আর সরকারি সমর্থন পেয়ে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর চালিয়েছে অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন। এই নিপীড়ন অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ওপর এখনো চলছে বলে মাঝেমধ্যে সংবাদ পাই।

মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের মতো মানবতা বিরোধী অপরাধে দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী মাত্রা ছাড়িয়ে মানবিক বিশ্বের নজর আকৃষ্ট করেছে। শতশত বছর ধরে পূর্বপুরুষানুক্রমে রাখাইন রাজ্যে বসবাসের পরও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষকে মিয়ানমার আপনার লোক বলে গ্রহণে অসম্মতি জানায়।

Advertisement

উন্মূল এক বিরাট জনগোষ্ঠীর মানুষ রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় পেয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাময়িক আশ্রয় দিয়ে, তাদেরকে বেঁচে থাকবার সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ আর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মানবতার পক্ষে নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলেছেন বিশ্ব বিবেকের কাছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাই মানবতার জননী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন সমগ্র বিশ্বে।

আশা করা গিয়েছিল রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে মিয়ানমার ও সেদেশের সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করবে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাস নিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও এবং চরম মানবেতর জীবন যাপন দেখেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং স্বাক্ষরিত বিভিন্ন প্রকার সমঝোতা ও চুক্তির আড়ালে তারা কেবলই কালক্ষেপণ করে চলেছে।

সমঝোতার ফাঁকফোকরগুলো ধূর্ততার সঙ্গে নিজেদের অনুকূলে প্রয়োগেই বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরকে ভিনদেশি হিসেবে প্রচারে উগ্রপন্থি বৌদ্ধ সম্প্রদায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-কে মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কট্টর ও উগগ্রবাদী বৌদ্ধদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তৎপড়তাকে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘দেশটিতে ফেসবুক হিংস্র জন্তুতে পরিণত হয়েছে’।

দেশের পাঁচ কোটি মানুষের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটি আশি লাখ। এদের অধিকসংখ্যকই আবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও উস্কানিমূলক বক্তব্য বিবৃতি প্রচারে বেশি ব্যস্ত। মানবিক বিশ্বে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন মা বা থাকে নিজের প্ল্যাটফরম থেকে নিষিদ্ধ ও কালো তালিকাভুক্ত করেছে।

এছাড়াও, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে দ্ইুজন সুপরিচিত বৌদ্ধ ভিক্ষু পারমাউক্ষা ও থুসেইত্তার বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা এর আগে জানুয়ারি মাসে দেখেছি আরেক কট্টর বৌদ্ধ ভিক্ষু উইরাথুকে ফেসবুক নিষিদ্ধ করেছিল। রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার নিজেই যখন রোহিঙ্গা নামক জাতিগোষ্ঠীর ওপর খড়গহস্ত তখন অপরাপর কট্টর বা উগ্রপন্থিদের ওপর দোষ চাপানো সর্বোতভাবে যথার্থ নয়। আমরা বিশ্বের অপরাপর রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রত্যাশা করি তারা যেন মানবতার প্রশ্নে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর জন্য নিজেদের সমর্থনটুকু স্পষ্ট করেন। আর মিয়ানমারকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হয়ে আত্মপ্রকাশের লক্ষ্যে অবিরাম চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন। বিশ্বকে মানবতাবদী করতে করলে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে মানবিক হতে হবে। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা মিয়ানমারের ভেতরমহলে যেসব অসঙ্গতি আর অপূর্ণতা দেখি তা বিশ্বের সকলের প্রচেষ্টায় দূর করতে হবে।

ইচ্ছে হলেই কোনো জাতিগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র উচ্ছেদ করতে পারে না- একথা তাদের বুঝাতে হবে। অথচ দীর্ঘ দিন ধরে সময় সময় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মিয়ানমারকে আরো বুঝাতে হবে যে, চুক্তি করার পর সভ্য জগতে চুক্তি ভঙ্গ করা যায় না। আর বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি মারাত্মক অপরাধ। চুক্তি ভঙ্গের অপরাধেও মিয়ানমারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সংকেত বিশ্ববাসীকেই দিতে হবে। মিয়ানমারের মতো কট্টর রাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থাপনায় কিংবা মানবিক প্রেক্ষাপটে বড় বেশি বেমানান; বড় বেশি অমানবিকও বটে।

সম্প্রতি কানাডায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর শীর্ষ সম্মেলনের আউটরিচ অধিবেশনে আমন্ত্রিত হয়ে যেসব বিষয়ে ভাষণ প্রদান করেন তারমধ্যে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গই প্রধান। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের উপর্যুপরি প্রচেষ্টা চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে তিনি সাংগাঠনিকভাবে জি-৭-এর প্রতি আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন ‘রোহিঙ্গা সমস্যার মূল মিয়ানমারেই নিহিত এবং তাদেরকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

রোহিঙ্গাদের তাদেরকেই দেশে ফেরৎ নিতে হবে যেখানে শতশত বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছে। ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অধিকার নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছি। এই প্রক্রিয়া যাতে স্থায়ী ও টেকসই হয় সে জন্য আমরা ইউএনএইচসিআরকে অন্তর্ভুক্ত করেছি।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জি-৭ সমম্মেলনে আরো বলেছেন ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধ অথবা তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

কেবল চুক্তি বা সমঝোতার স্বাক্ষর করেই মিয়ানমার যেন নিজের দায় এড়াতে না পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বকে সুনির্দিষ্টভাবে রাখাইন রাজ্যে নিজ মাতৃভূমিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে সাময়িক আশ্রয়দানের পর বিশ্ববাসী যেমন বাংলাদেশের প্রশংসা করে রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তেমনি এখন সময় এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের পাশে বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর।

কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে ‘বাস্তুচ্যুত’ জাতীয় অসম্মানসূচক খেতাবটি দূর করে নিজদেশে তাদেরকে আত্মমর্যাদার সাথে বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে মানবিক বিশ্ববাসীকেই। বিশ্ববাসীকে দেখতে হবে সমঝোতা বা চুক্তির কোনো অসঙ্গতির অজুহাত দেখিয়ে মিয়ানমার যেন তার দায় এড়াতে না পারে। তাই শেখ হাসিনার মানবিক আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানাই।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস