অর্থনীতি

আইন সংশোধন ও পৃথক বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ নেই

>> রাজনৈতিক প্রভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না বাংলাদেশ ব্যাংক>> ১৯৯৮ সালে ৩টি সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক, যা এখনও কার্যকর হয়নি>> বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার কম>> প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে : মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

Advertisement

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের (ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে দায়ের করা বিভিন্ন রিট মামলায় আটকে আছে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। যা মোট ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ।

আরও পড়ুন >> হাইকোর্টে রিট করলেই পার পাওয়া যায়

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অর্থঋণ আদালতের রায়ের ৯০ ভাগ ব্যাংকের পক্ষে আসে। কিন্তু আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খেলাপি ঋণগ্রহীতারা ইচ্ছাকৃতভাবে নানা কৌশলে ঋণ পরিশোধ বিলম্বিতের জন্য রিট মামলা দায়ের করেন। সে কারণে অর্থ আদায় সম্ভব হচ্ছে না। অনেক দিন ধরে আর্থিক খাত সংক্রান্ত রিট মামলাসমূহের নিষ্পত্তি ত্বরান্বিতের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে দুটি পৃথক বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

Advertisement

আরও জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাট থেকে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে রক্ষায় ১৯৯৮ সালে তিনটি সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো- কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক পদ্ধতি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর আদালতব্যবস্থা গড়ে তোলা। এগুলো নিশ্চিত করা না হলে আমানতের সুরক্ষা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ সম্ভব হবে না। এরপরও গত ২০ বছরে ব্যাংক খাতে ওই তিন প্রস্তাবের কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি।

আরও পড়ুন >> খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে সাড়ে ৮৮ হাজার কোটি টাকা

২০০৩ সালে বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে পর্যালোচনা করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)। পর্যালোচনার পর সংস্থা দুটি টেকসই ব্যাংক খাত গড়ে তুলতে বেশকিছু সুপারিশ করে। কিন্তু সেগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা সেই সময়ের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে।

ওই সময় সংস্থা দুটি বলেছিল, ব্যাংক খাতের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অনিয়মই চিহ্নিত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে সেগুলো রোধের মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না।

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংককে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করেছিল তারা। এছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে খেলাপি অর্থ আদায়ে ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল সংস্থা দুটি। ঋণখেলাপিরা যাতে উচ্চ আদালত থেকে সাদা হয়ে এসে আবার নতুন করে ঋণ নিতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেসবের কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।

আরও পড়ুন >> ১২ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

এদিকে, উচ্চ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ গঠনের অনুরোধ জানিয়ে বেশ কিছুদিন আগে দু’দফা এবং সম্প্রতি একবার- মোট তিন দফা আইনমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থঋণ সংক্রান্ত রিটে ব্যাংক খাত কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- সেই চিত্র তুলে ধরেন। কিন্তু এরপরও কোনো কাজ হয়নি।

এছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের সুপারিশ করে আইন কমিশন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং আইন কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. এম শাহ আলম ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর এ সুপারিশ করেন। তাদের সুপারিশ সত্ত্বেও অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের জন্য তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।

আইন কমিশনের মতে, আর্থিক ঋণের সংজ্ঞায় রয়েছে দুর্বলতা। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে মামলার নিষ্পত্তির হার কম। ঋণ আদায়ে বিবাদীদের প্রতি সমন জারির প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণের অর্থ আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীর বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একতরফা ডিক্রি জারি হলেও পরে বিবাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় বিচার কাজ শুরু হওয়ার সুযোগ থাকছে।

আরও পড়ুন >> ঋণ গ্রহণ ও আদায়কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার পরামর্শ

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থঋণ আদালতের রায়ের ৯০ ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আসে। কিন্তু আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খেলাপি ঋণগ্রহীতারা ইচ্ছাকৃতভাবে নানা কৌশলে ঋণ পরিশোধ বিলম্বিতের জন্য হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেন। যে কারণে অর্থ আদায় সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ব্যাংকগুলোর অল্প টাকায় নিয়োজিত প্যানেলভুক্ত অনভিজ্ঞ আইনজীবীর চেয়ে ঋণখেলাপিদের আইনজীবীরা অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ। এতে উচ্চ আদালতে রিটের শুনানিতে ব্যাংকের পক্ষ যুক্তিতর্কে হেরে যায়।

পাশাপাশি দলীয় আনুগত্য ও তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর লিগ্যাল অ্যাডভাইজারদের বিরুদ্ধে। সরকারি দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে যোগ্যতা নিয়ে তাদের কখনও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। এছাড়া একটি মামলা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে একাধিক মামলা। এতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে মূল মামলা।

অন্যদিকে, উচ্চ আদালতে অর্থঋণ মামলার শুনানির জন্য পৃথক বেঞ্চ না থাকায় কাঙ্ক্ষিত হারে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে মামলার জট।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেসব ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, সেগুলো আদায়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থঋণ আদালতে প্রচুর মামলা ঝুলে আছে। সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উচ্চ আদালতেও অনেক মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। সেগুলো নিষ্পত্তির বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

আরও পড়ুন >> কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ভূমিকা রাখতে পারছে না

‘এমন ধীরগতির বিচারিক ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় বের করে সেগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে ঋণ গ্রহণ ও আদায়ে যেন কোনো রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিতের উপরও জোর দেন এ অর্থনীতিবিদ।

তিনি আরও বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক যাতে সহজেই জামানত বিক্রি করতে পারে বা বন্ধকি সম্পত্তি দখলে নিয়ে পরিচালনা করতে পারে সে জন্য অর্থঋণ আদালত আইন যুগোপযোগী করতে হবে। অর্থাৎ আইন হতে হবে ব্যাংকের পক্ষে।

এমইউএইচ/এমএআর/এমএস