রাশিয়ার রাজধানী মস্কো যেন বিভিন্ন জাতি এবং সংস্কৃতির মিলনমেলা। বৈশ্বিক হয়ে ওঠার এটাও একটা বড় নির্দশন। যেখানে রয়েছে ভারতীয় বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্যও। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহেরু কিংবা ইন্দিরা গান্ধীরও ভাস্কর্য রয়েছে সেখানে। রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বিশাল ভাস্কর্য তো বিশ্বকাপের মূল মঞ্চ লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সম্মুখভাগেই শোভা পাচ্ছে।
Advertisement
বিশ্বকাপের পর এই মস্কোতেই যদি কোনো কোনো ফুটবলারের ভাস্কর্য বসে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু বাকি থাকবে না। আর সেই ভাস্কর্যটা যদি মেসি-নেইমারদের মত বিশ্বখ্যাত ফুটবলারদের বাদ দিয়ে অখ্যাত কারও হয়ে যায় তারপরও অবাক হওয়ার মত কোনো ব্যাপার ঘটবে না। কারণ, রাশিয়া বিশ্বকাপটা এখনও পর্যন্ত যা উপহার দিয়েছে ফুটবল বিশ্বকে, তা তো রীতিমত বিস্ময়কর।
বিশ্বকাপটা এমনও হতে পারে, তা সম্ভবত কারো ধারণাতেই ছিল না। রাশিয়ায় আসার আগে প্রতিটি দল যে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রস্তুতি এবং প্রতিপক্ষ সম্পর্কে যথেষ্ট অধ্যাবসায় করেই তবে এসেছে। যে কারণে, শুরু থেকেই অনেকটাই অঘটনের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, রাশিয়ায় চলমান ২১তম বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের ২০টি আসর এর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কত হাসি-কান্না, ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তির দিকে এগিয়েছে প্রতিটি টুর্নামেন্ট। বিশ্বকাপ যেহেতু বিশ্বজনীন, সবারই সমানভাবে নিজেকে প্রদর্শণ করা সুযোগ। এটা যেহেতু একটা প্রতিযোগিতা, সমানভাবে লড়াই করার মঞ্চ, সুতরাং কখনও-কখনও ছোটরাও বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বমঞ্চে।
Advertisement
১৯৫০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলে যুক্তরাষ্ট্রের হারিয়ে দেয়া, ব্রাজিলকে ফাইনালে পরিণত হওয়া শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের হারিয়ে দেয়া, ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ‘মিরাকল অব বার্ন’ নামে পরিচিত ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানির হারিয়ে দেয়াটা বিস্ময়কর।
তার চেয়েও বিস্ময়কর, ১৯৬২ বিশ্বকাপে চিলির সুইজারল্যান্ড এবং ইতালিকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যাওয়া, কিংবা ১৯৬৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে উত্তর কোরিয়া ইতালিকে হারিয়ে দেয়ার ঘটনা তোলপাড় তুলে দিয়েছিল সারা ফুটবল বিশ্বে। সেই উত্তর কোরিয়া পর্তুগালের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ২৫ মিনিটের মধ্যে ৩ গোল দিয়ে রূপকথার জন্ম দিতে গিয়েছিল। কিন্তু ইউসেবিওর মত কিংবদন্তির হ্যাটট্রিকের সুবাধে উল্টো রূপকথা লিখেছিল পর্তুগিজরা। ওই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ব্রাজিলের বিদায় নেয়ার ঘটনা আরও বিস্ময়কর।
১৯৮২ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে নবাগত আলজেরিয়ার কাছে শক্তিশালী পশ্চিত জার্মানির হেরে যাওয়ার ঘটনাও বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বড় অঘটন। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই নেদারল্যান্ডসের কাছে ৫-১ গোলে এবং চিলির কাছে ২-০ গোলে স্পেনের হারের সঙ্গে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালির কোস্টারিকা এবং উরুগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নেয়ার ঘটনাও কম নয়। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ইংল্যান্ড এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালও।
২০১০ বিশ্বকাপও অঘটনের জন্ম দিয়েছিল অবস্থা। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি স্লোভাকিয়ার মত দলের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। ফেবারিটদের মধ্যে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ফ্রান্সও। ২০০২ বিশ্বকাপও দেখেছিল প্রায় একই অঘটন। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল নবাগত সেনেগাল। শেষ পর্যন্ত গ্রুপ পর্ব থেকেই ফ্রান্সের বিদায়। একইভাবে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল প্রবল ফেবারিট আর্জেন্টিনাকেও।
Advertisement
বিশ্বকাপে যে ছোটরাও বড় দলে হয়ে উঠতে পারে, আগের বিশ্বকাপগুলোয় ঘটে যাওয়া এসব ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। কিন্তু তাই বলে এতটা? গণহারে ফেবারিটদের বারোটা বাজিয়ে দেয়ার মত কোন বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এর আগে? রাশিয়া বিশ্বকাপ যা দেখাচ্ছে, তাতে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ই রচনা হতে যাচ্ছে বলা যায়।
এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে ফেবারিটের তালিকায় যারা রয়েছে সেই পাঁচটি দল, জার্মানি, ব্রাজিল, স্পেন, ফ্রান্স এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সছাড়া প্রতিটি দলই হোঁচট খেয়েছে। ড্র করেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং স্পেন। সবচেয়ে ফেবারিট জার্মানি তো নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেরেই গিয়েছে। মেক্সিকো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানিকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে। ফ্রান্স জিতলেও সেটা ছিল খুবই কষ্টার্জিত। ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির (ভিএআর) সহায়তা নিয়ে। ফলে তাদের জয়টি নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিনই মাঠে নেমে পর্তুগালের সামনে থমকে যায় ফেবারিট স্পেন। রোনালদোর হ্যাটট্রিকে ৩-৩ গোলে ড্র করে স্প্যানিশরা। পরেরদিন মাঠে নেমে নবাগত আইসল্যান্ডের সঙ্গে বড় ধাক্কা খেলো লিওনেল মেসিদের টপ ফেবারিট দল আর্জেন্টিনা। ১-১ গোলে ড্র করতে হলো। পরেরদিন শুরুতে মেক্সিকোর কাছে হেরে বসলো জার্মানি। পরের ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের মুখোমুখি হয়ে ১-১ গোলে ড্র করলো আরেক ফেবারিট ব্রাজিল।
ডার্কহর্সদের মধ্যে যারা ফেবারিটের তালিকায় উঠে আসতে পারে, তেমন দুটি দল বেলজিয়াম এবং ইংল্যান্ড। এই দুটি দল অনায়াস জয় তুলে নিয়েছে। বেলজিয়াম ৩-০ গোলে হারিয়েছে আরেক নবাগত পানামাকে। ইংল্যান্ডও হোঁচট খেতে খেতে গিয়ে বেঁছে গেলো শেষ মুহূর্তে হ্যারি কেইনের গোলের কল্যাণে। লাতিন আমেরিকার মাঝারি মানের দুটি দল উরুগুয়ে প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলে মিসরকে হারালেও জাপানের কাছে হোঁচট খেয়েছে কলম্বিয়া।
এই হলো মোটামুটি প্রতিটি দলের একটি করে ম্যাচ খেলার পর অবস্থা। এখনও পর্যন্ত অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এটা অঘটনের বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে না। সামনে বড় দলগুলোর সামনে কী অপেক্ষা করছে সেটা এখনও জানা নেই। তবে, অবস্থা যা, তা দেখে মনে হচ্ছে, ছোট-বড় বলতে আর কিছুই নেই। প্রতিটি দলই সমান। সেটা এশিয়া, আফ্রিকা হোক কিংবা ইউরোপ-লাতিন আমেরিকা হোক। ফুটবলীয় কৌশল আর ট্যাকটিসগুলো ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে বিশ্বকাপে খেলতে আসা প্রতিটি দেশ। একই সঙ্গে নিজেদের রক্ষণভাগকে জমাট রেখে, কিভাবে পাল্টা আক্রমণে উঠে গিয়ে গোল আদায় করে নিতে হয় সেটাও ভালোভাবেই প্রদর্শণ করেছে প্রায় প্রতিটি দল।
ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করলে প্রথম ম্যাচের পর কাউকেই নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে না। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ছাড়া আর কেউই সূর্য হয়ে ওঠেননি। হ্যাটট্রিক করলেও রোনালদো কিন্তু জেতাতে পারেননি, ড্র করেছেন। তাবৎ ফুটবল বিশ্বকেই এখন অনেকাংশে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে এভাবে ফেবারিটদের হোঁচট খাওয়া দেখে।
কেন বড় দলগুলো এভাবে ব্যর্থ হচ্ছে? চলছে নানা বিশ্লেষণ। এর অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসছে বেশ কিছু কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বড় দলগুলো একসঙ্গে বেশিদিন অনুশীলন করার সুযোগ পায় না এখন। মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড যতদিন একসঙ্গে অনুশীলন করেছে, জার্মানি, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা সে সুযোগ পায়নি। ইউরোপিয়ান বিভিন্ন লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিয়ে এসব দেশের তারকারা ব্যস্ত থাকার কারণে।
রোনালদো হ্যাটট্রিক পেয়েছেন অন্য কারণে। প্রতিপক্ষ স্পেনও বড় দল বলে, তাকে পুলিশের মত মার্কিংয়ে পড়তে হয়নি বলে। মেসি, নেইমার বা থমাস মুলারকে প্রতিপক্ষরা ঘিরে রেখেছিল সব সময়। প্রতিটি দলেরই টিমগুলোর প্রাথমিক মনোভাব ছিল এক- হারা চলবে না। ডিফেন্সে প্রায়ই ‘বাস পার্ক’ করে রেখে খেলেছে তারা।
বড় দলগুলোর এমন হোঁচট খাওয়ার আরও কারণের মধ্যে রয়েছে, বিশ্বকাপ খেলতে এসেও তাদের বিলাসবহুল জীবন-যাপন। জার্মানি ম্যাচ হেরেই চলে গেছে ক্লোজড ডোর ট্রেনিংয়ে। মস্কোরই কাছাকাছি। বিশ্বকাপে এসে মস্কোর শহরতলিতে ঘাঁটি গেড়েছে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স এবং পর্তুগাল। ব্রাজিল ও স্পেন অনেকটা দূরে ক্রাসনোদারে। ব্রাজিল রাশিয়ার অন্য প্রান্তে, সোচিতে।
এদের মধ্যে জার্মানি, ব্রাজিল এবং ফ্রান্স ঘাঁটি গেড়েছে বিশাল হোটেলে। আর্জেন্টিনা, স্পেন, পর্তুগালও রাশিয়ার বড় কোনো অ্যাকাডেমিতে। মোটামুটি সব বিশ্বকাপেই এক থিওরি মেনে হোটেল এবং অ্যাকাডেমি বাছাই করে বড়বড় দলগুলো। সেখানে খেলোয়াড়দের বিলাসবহুল জীবন-যাপনও খেলায় অনেকটা প্রভাব ফেলতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া প্রতিটি ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে কোচদের কথাবার্তা শুনে প্রথম ম্যাচে ফেবারিটদের ব্যর্থতার আরও কিছু কারণ বের হয়ে এসেছে। সে সব কথা-বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রতিটি ফেবারিটের সেরা ফুটবলারকে মার্ক করার ট্যাকটিকস। মেসি, নেইমার, ক্রুস- তিন জনকে টার্গেট করেই ফসল তুলে নিয়েছে প্রতিপক্ষ তিনটি দল। জার্মানি, স্পেন, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং পর্তুগাল- অবাক করে দিয়ে সবাই খেলেছে ৪-২-৩-১ ছকে। মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ডও খেলল একই ফরমেশনে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচই বলে দিয়ে যাচ্ছে, ৪-২-৩-১ ফরমেশনই এখন জনপ্রিয় ছক।
আরও একটা বড় উপলব্ধি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ম্যান মার্কিংয়ের অস্ত্র ইদানিং অচল হয়ে দাঁড়িয়েছিল; কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ফিরে এসেছে সেই অকেজো অস্ত্রই এবং প্রবল ভাবে। শুধু ম্যান মার্কিং নয়। সঙ্গে থাকছে প্রবল পাল্টা আক্রমণ। ম্যান মার্কিং মানেই যে ডিফেন্সিভ খেলতে হবে, তা নয়। আক্রমণাত্মকও হয়ে উঠছে ছোট দলগুলো। যার ফলেই হোঁচট খাচ্ছে ফেবারিটরা।
আইএইচএস/এমএস