সাহিত্য

চোর

নাজনীন তৌহিদ : গ্রামে গঞ্জে গৃহস্তের বাড়ি এক আধবার চুরি হয়নি এটা ভাবনাতিত। চুরির আবার বিভিন্ন রকম সকম আছে। যেমন ছিঁচকে চুরি, সিঁদ কাটা চুরি আর পুকুর চুরি  সবার জানা কথা। এ চুরি বিদ্যাটিতে কিন্ত চাতুরি বুদ্ধি দিয়ে বড় সড় একেবারে উচ্চতর ডিগ্রী ধারণ করতে হয়। তাই কথায় বলে, চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না ধরা যায়। যাক সে বিদ্যা বুদ্ধির কথা। আসল ঘটনায় ফিরি।ঘটনা ঘটেছে কমলাবুনিয়া গ্রামে । গ্রামটির একপাশ ঘেঁষা একটি খাল কল কল ধ্বনিতে বয়ে  চলেছে। খালে এক পাড়ে কমলা বুনিয়া গ্রাম । অপর পাড়ের নাম কামলাগ্রাম। নামে অদ্ভুদ রকমের মিল থাকলেও কাজে মিল নেই। কোন কালে কমলা খেয়েছিল কোন বনেদি পরিবার। সে কমলা লেবুর বীজ বুনেছিল কামলারা অর্থাৎ গা খাটা মানুষেরা । তাই গা খাটা মানুষের বসবাস থেকে কামলা গ্রামের নামকরণ আর কমলা বুনিয়া তো সহজে বোঝা গেল। আর নাম থেকেও বোঝা যাচ্ছে কামলা গ্রামে মুখ্যসুখ্য মানুষের বাস যাদের চারিত্রিক গুণাবলীও অনেক সময় হা ভাতে । হাভাতে থাকলে হাত টানের অভ্যেসটা স্বভাবে পরিণত হতে সময় লাগে না। তাই সহজ কথায় বলতে হয় এ পাড়ায় চোরের বসবাস - তারা নিজেদের পক্ষে যতই সাফাই গাক না কেন ও পাড়ার বনেদি লোকেরা এদেরকে মানুষ বলে গণ্য করে না। করবে কি করে ? কামলারা কি মানুষ (?) মরার পরে খাড়ার ঘা এর মত উপনাম জুটেছে জোচ্চোর । এই মুখ্যসুখ্যদের গায়ের চামড়াটাও গণ্ডারের চামড়া- যে যা বলে যেন সব গা সওয়া হয়ে গেছে।কমলাবুনিয়ার মানুষ নবাব গোছের - খাই দাই পোদ্দারি চালাই । নবাবী হালে দিন গুজরান ভালই চলছিল তাদের। তবে দিনে দিনে এমন অবস্থা হয়েছে যে, উনন উচ্ছে যাবার জোগাড়। ঘরে ভাত জোটে না তাতে কি ! পরনে তবু ভাল পিরান, পকেটে পয়সা নেই তবু চায়ে গরম ধোঁয়া। তা আবার গরুর দুধের খাঁটি চা। এমন প্রতিবেশিদের মাঝে তো বংশগত, বর্ণগত সব দিক থেকেই সাপে নেউলে সম্পর্ক থাকবেই।দু’গ্রামের বর্ণনা যখন পেলাম তখন চুরির ঘটনায় ফেরা যাক। কামলার লোকেদের হাতটানের অভ্যেসটা বংশপরম্পরায় বিস্তার লাভ করছে। তাদের চুরি আবার সিজনাল চুরি বা মৌসুমী চুরি। যেমন গ্রীষ্মে আম-কাঠাল চুরি, বর্ষায় পুকুরের মাছ চুরি, শরতে (ভাদ্রে) তাল চুরি, হেমন্তে সুপারি চুরি, শীতে খেঁজুরের রস চুরি, বসন্তে গাছের নতুন কুড়ি চুরি আর সর্ব সময়ে পেয়ারা, লেবু, কচু-ঘেচু, শাকটা-পাতাটা তো আছেই। দু’গাঁয়ের মেলামেশা বন্ধ থাকবে বলেই খালের উপরে সাঁকোটাও থাকে না। কিন্তু  এতে চোরের এ গাঁয়ে আসতে  আদৌ সমস্যা হয় না বরং সুবিধা। চুরির মাল গৃহ কর্তারা শনাক্ত করতে আসতে পারে না। আরও সুবিধা, গা খাটা চাষাভূষা বলে গায়ে বাড়তি ঝামেলার পোশাক না চাপালেই হলো, শত ছিদ্রে ফাটাফুটি লুঙ্গিটা মালকোচা দিলেই যথেষ্ট। তাই এপাড়ে যখন আসার সময় হয়, ভাটার সময় হাঁটু পানি হেঁটে পার হওয়া আর জোয়ারে পরনের লুঙ্গিটা তুলে মাথায় চেপে নির্বিঘ্নে খাল সাঁতরে পার হওয়া। শরীরের নিম্মদেশ তো পানির নিচে থাকে তাই ওখানটায় বাড়তি কাপড় না হলেই চলে। এ পাড়ে এসে মাথায় তোলা লুঙ্গিটা নিচের লজ্জা স্থানে ছেড়ে দেয়। ফল-মূল অর্থাৎ চুরির সম্পদ নিতেও বাড়তি ব্যাগ-বাট্টার প্রয়োজন নেই। লুঙ্গির কোচরে ভরলেই হয়। যথা নিয়মে খাল পার হয়ে ফিরে যাওয়া এ ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।এ পাড়ের কমলাবুনিয়াতে কিছুদিন ধরে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করছেন শিকদার সাহেব। পাকাপাকি বলতে আগে চাকুরির সুবাদে শহরে থাকতেন, হঠাৎ অসুস্থ ,পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে শিকদার সাহেব স্ত্রী এবং মাকে নিয়ে গ্রামে পাকা ঘর তুলে পাকাপাকি থাকবেন বলে মনস্থির করেছে কিন্তু যত সমস্যা তার বাড়িতেই ঘটছে। ছেলে পুলেরা শিক্ষিত, চাকুরিজীবি তাই শহরে বসবাস। দিনে দু’ চার বার মুঠোফোনে কুশলাদি বিনিময় হয়। প্রয়োজনীয় সব কিছু পাঠিয়ে দেয়। বাড়িতে তাদেরকে দেখা শুনার জন্য আছে প্রতিবেশি জ্ঞাতি ভাই। শিকদার সাহেব এক সময় দাপোটে লোক ছিলেন। দোতলা ঘরের উপর তলায় তিনি দু’নলা বন্দুক নিয়ে ঘুমাতেন। চোর দূরে থাক চোরের বাবারাও ভয়ে এ পাড়া মারাত না তখন। গ্রামে বন্দুক থাক মানে অনেক বড় শক্তির আধার। শিকদার সাহেবের নাম ডাকও নেহায়েত কম ছিল না। বিচার-আচার, বিয়ে-শাদী সব জায়গাতে সামনে সারি। এই শিকদার সাহেব বহুদিন বাদে আবার গ্রামে ফিরে এসেছেন। কিন্তু বন্দুক চালানো দূরে থাক তিনি এখন নিজেকেই চালাতে পারেন না। তার স্ত্রীও হাতে ব্যথা, পায়ে ব্যথা নিয়ে চলছেন। বৃদ্ধা মাতার দু`চোখ অন্ধ। তবু তার সজাগ দৃষ্টি । কোথায় পাতা পড়ল, কুকুরটা লেজ নাড়ল, বেড়ালটা ছুটল তার জন্য তিনি দু`চোখ মেলে কান খাড়া করে থাকেন। যখন খাবার খেতে বসেন বেড়াল তার সাথে লহমা দেয় বেচারি বুঝতেও পারে না ! এই যার সজাগ দৃষ্টি সে তো চোর পাকড়ানোতে বেজায় যায় ! চোর আসে তার সম্মুখ থেকে তিনি চোরের দিকে তাকিয়েই থাকেন।এই যাদের অবস্থা সেখানে চোরেরা টার্গেট তো ফিক্সড করবেই । মাঝে মাঝে এমন চুরি হয়, পরনের কাপড় ছাড়া ঘরে কিছুই থাকে না। শহরে থাকা সন্তানেরা আবার সব দিয়ে ঘর ভর্তি করে ফেলে। কিন্ত লাভ কি ? লাভ চোরদের। তারা নতুন নতুন জিনিসের স্বাদ পায়। তারমানে যত চুরি তত লাভ ! ছেলে মেয়েরাও এখন চুরির ঘটনাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। সিকদার সাহেবের স্ত্রী এবার মহা চটেছেন। যে করে হোক একটা হ্যাস্ত ন্যাস্ত এবার করতেই হবে। গ্রামের বড় পীরের কাছ থেকে তাবিজ কবজ আনা হল। বাড়ি বন্ধক দেয়া হল। এবার চোর পালাবে কোথায় ? ধরা তার পরতেই হবে ! কিন্তু চুরিটা করে কে ?খালের ওপারের কামলারা তো ছিঁচকে চোর । তাছাড়া ও পাড়ার বড় চোরা মুক্তার কিছুদিন আগে ইহধাম ত্যাগ করেছে। ভিন গাঁয়ের ধলু চোরা ক’দিন আগে খালে ভেসে আসা গলাকাটা মহিলা লাশের পরনের শাড়িটা চুরি করে বউকে পরিয়ে ছিল বলে ঘরে তার বড় ক্ষতি হয়েছে। সে থেকে চুরি ছেড়েছে। গ্রাম্য শালিসে নাকে খতও দিয়েছে।  প্রতিবেশি ভাইটি রাত দুপুরেও হাঁক ডাক দেয়।  “ভয় নেই আমি আছি ” ! তাই কিছুটা নিশ্চিত মনে শিকদার পরিবার চলছিল। কিছুদিন আগে ঈদে ছেলে মেয়ে বেড়াতে এলে তাদের এটা ওটা খোয়া গেলেও মাকে তেমন করে কিছু জানায়নি। ঈদে মাকে সোনার গয়না, শাড়ি দিয়ে সাজালো। ঘর পাকা করার জন্য টাকা পয়সাও দিল। এদিকে শীতকাল হু-হু করে শীতের প্রকোপ বেশি পড়ছে বলে শিকদার সাহেব ঘরের বাইরে বেশি বের হচ্ছেন না। প্রকৃতির ডাকেও তেমন সাড়া দেন না । ফজরের নামাজ অনেক সময় কাযা হয়ে যায় । এত লেপ কম্বলেও যেন শীত মানে না, স্ত্রীর শাড়ির আঁচল কেটে বানানো মাফলার দিয়ে মাথা মুড়ে নেন ভাল করে। এমনি এক সকালে ফজরের আযান শুনে স্ত্রী তার ঘরের বাহিরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে সে সাথে অজু করতে বের হয়েছেন। গজ গজিয়ে মনে মনে বলছেন, মোয়াজ্জেমের বুঝি কাজ নাই। ওয়াক্ত হতে না হতেই রাত থাকতেই ফজর বানিয়ে দিল। সারা রাত ওয়াজ নসিয়ত করে বেচারা মুয়াজ্জেম ঘুমাতে পারে নাই। তাই ফজরের নামায আগে ভাগে শেষ করেই আরেকবার ঘুমাবেন বলেই ভাবছিলেন। এদিকে ঘর খোলা পেয়ে নির্বিঘ্নে চুরি করতে ঢুকেছে চোর। শাড়ির আঁচলে মোড়া শিকদার সাহেবকে দেখে চোর শিকদার গিন্নী ভেবে বালিশের নিচে রাখা মোবাইল নিল, চাবি খুঁজতে গিয়ে ভাবল কানের দুল আর গলার চেইনটাও নেয়া যাক। তাই চোর দু’হাত দিয়ে গলা জড়াজড়ি করছে। শিকদার সাহেব ভাবছে, স্ত্রী ঠাণ্ডার প্রকোপ বুঝে জড়িয়ে ধরছে তাকে, সেও তাই সাড়া দিয়ে চোর কে স্ত্রী ভেবে জাপটে ধরেছে। ততক্ষণে শিকদার গিন্নী ওজু শেষে দোয়া পড়তে পড়তে ঘরে এসে আলো জ্বালালেন, ওমনি তার দৃষ্টি বিছানায় নিবদ্ধ হল। পাশে রাখা শিকদার সাহেবের বেতের লাঠিটা বেশ কাজে আসল। চোর আর পালায় কোথায় ? শিকদার গিন্নীর পুরোপুরি বোধগম্য হল চুরির রহস্য । দুধ কলা দিয়ে তবে সাপ পোষা ?চোর তো ধরা পড়ল তবে শিকদার গিন্নীর তাবিজের প্রতি অটল বিশ্বাস জম্মালো। ছেলে মেয়েদেরকে এতদিনে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, হুজুরের দোয়ার বরকতে চোর ধরা পড়েছে। তবে এই তাবিজ যে এ জ্ঞাতি ভাইটি এনে দিয়েছিল তা কিন্তু বে-মালুম ভুলে গেলেন। শেষ খবর অব্দি দেখে এসেছি সেই অর্কমা ভাইটি মিলে মিশে আবার শিকদার সাহেবের সাথে দুধে ভাতেই আছে।  এইচআর/পিআর

Advertisement