মতামত

আমার রান্না শেখা ও সিদ্দিকা কবীর

টমি মিয়ার বেশ ক’টি বই রয়েছে বাজারে। বেশিরভাগই রেসিপি। অনুবাদ বই। প্রায় সবগুলো অনুবাদই আমার করা। বিখ্যাত শেফ টমি মিয়া। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সাপ্তাহিক ২০০০ এ কাজের সুবাদে। স্থপতি শাহরিয়ার ইকবাল রাজের মাধ্যমে। রাজ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন। সেখানে তাদের পরিচয়। তার মাধ্যমেই প্রস্তাব আসে, টমি মিয়ার বই অনুবাদের। প্রস্তাবটা আমার কাছে যতটা না আকর্ষণীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। জগত বিখ্যাত শেফ টমি মিয়ার রেসিপি বইগুলোতে আমারও নাম থাকবে, ভাবতেই পুলকবোধ করি আমি।

Advertisement

টমির বই অনুবাদ করতে গিয়ে রান্নার খুঁটিনাটি কত টার্মই না জানা হয়, শেখা হয়।

সেমাইয়ের ইংরেজি ‘ভার্মাচিলি’ তাও জেনেছি টমির অনুবাদ করতে গিয়েই। আজকে যে খবরের কাগজ আর টেলিভিশনে রেসিপি নিয়ে এত আয়োজন তার শুরুটাও হয়েছিল শাহাদত চৌধুরীর হাত ধরে, সাপ্তাহিক ২০০০ এর মাধ্যমে। ২০০০ ই প্রথম বাংলাদেশে ঈদ সংখ্যা, ঈদ ফ্যাশনের পাশাপাশি ‘ঈদ রান্না’ সংখ্যা করেছিল। শহরে নতুন নতুন রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, বিস্ট্রো হচ্ছে তার মানে লোকে বাড়ির গতানুগাতিক খাবারের বাইরে আরো মুখরোচক দেশি-বিদেশি স্বাদ পেতে চাইছে। খাবারের নতুন নতুন রেসিপি। লোকের নজর বাড়বে, আগ্রহ থাকবে এমন ভাবনা থেকেই সূচনা রান্না সংখ্যার।

টমি মিয়ার রেসিপি অনুবাদের অভিজ্ঞতা আমাকে সাপ্তাহিক ২০০০ এর রান্নার বিশেষ সংখ্যাতেও কাজের সুযোগ এনে দেয়। দেশে কেকা ফেরদৌসী, রাহিমা সুলতানা রিতা, টনি খান, লিনাস রোজারিও তপন, আর দেশের বাইরে সঞ্জীব কাপুরের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে সহসাই। প্রত্যেকেই নামজাদা শেফ, রন্ধনশিল্পী। কাজের সূত্রেই তাদের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সাপ্তাহিক ২০০০ এর রান্না সংখ্যা তখন রীতিমত বাজারে হিট আইটেম। নগরজীবনে ঈদ শপিংয়ে অনেক কিছুর সঙ্গে ‘রান্না সংখ্যা’ যোগ হয় বাড়তি চাওয়া হিসেবে। রাঁধুনী, নেসলে, ডানো এমন অনেক ব্যান্ড ফুড প্রোডাক্ট নিজেরাই স্পন্সর হওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা করতো সেখানে।

Advertisement

রেসিপি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছিল যে সম্পর্কটি, যে মানুষটি- তিনি সিদ্দিকা কবীর। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তার ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ আজও জনপ্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত এ মাস্টার্স করেছেন, যে সময়ে মেয়েরা ঘরবার হতো না, লেখাপড়া তো দূরের কথা। পরে ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটিতে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশানে উচ্চতর ডিগ্রি করেন। গড়ে তোলেন হোম ইকোনমিক্স কলেজ। সততা, মেধা ও মানবিকতার দারুণ মিশেল ছিলেন তিনি।

তখনও নিজে রান্না করতে শিখিনি। অনুবাদ করেছি, বিশেষ সংখ্যার সমন্বয়ক থেকেছি। দেখেছি লোকে রান্নার বিষয়টা ‘শুধু মেয়েদের’ বলে ভাবে। ফলে ভেতরে ভেতরে আগ্রহ থাকলেও কেমন যেন এক ধরনের সংকোচ ও জড়তায় ‘রান্না শিখতে চাই’ বলা হয়ে উঠেনি। একদিন তিনি নিজেই আমার অজ্ঞতার, অন্ধকারের জাল ছেড়েন। বলেন, তুমিতো ফুডের বিষয়ে ভালো জান, নিজে রান্না শেখো না কেন? আমি কিছু বলবার আগেই বলেন, রান্নার সঙ্গে কিন্তু ছেলে-মেয়ের কোন সম্পর্ক নেই। শুধু মাত্র আমাদের এখানেই লোকে ধারণা দিয়েছে রান্না মেয়েদের। খুব ভুল। রান্না সবার। খাবারের সঙ্গে ক্ষিদের সম্পর্ক, ক্ষিদের সঙ্গে রান্নার সম্পর্ক। আমি অবাক হয়ে শুনতে থাকি! দেখবে, বড় বড় হোটেল রেস্তোরাঁয় সব ছেলেরা রান্না করছে, অ্যাসিটেন্টও মেয়ে নেই। সব ছেলে। ওখানে আবার ভালো টাকা আছে। সেখানে মেয়েদের জায়গা নেই। যেখানে টাকা নেই সেখানে আবার মেয়েদের জায়গা আছে। আসলে পলিটিক্স। ইকোনমি অ্যান্ড জেন্ডার। রান্না সবার। এটা আর্ট। এটা সায়েন্স। শিল্প ও বিজ্ঞান।

আমার মুগ্ধতার ঘোর কাটে না, তাকে শুনবার। আমার ভেতর পুরুষতান্ত্রিকতার যত শিকল, দেয়াল, জঞ্জাল- এক নিমিষেই সরে যায়। উড়ে যায়, দূরে যায়।

সিদ্দিকা কবীর আমাকে রান্না শিখিয়েছিলেন, বড় যত্ন করে, ভালোবেসে। বলেছিলেন, তোমার মত স্মার্ট ছেলেরাইতো রান্না শিখবে। এনটিভিতে তার জনপ্রিয় টিভি শো ‘সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি’তে নিজের আগ্রহেই আমাকে অতিথি করেছিলেন।

Advertisement

সিদ্দিকা কবীরের কাছে শেখা অনেক রান্নার মধ্যে সেমাই আমার নিজেরই খুব প্রিয়। প্রতি ঈদে আমি নিজেই সেমাই রান্না করি সবার জন্য। শুধু আমি কেন, এদেশের খুব কম বাড়ি রয়েছে যেখানে সিদ্দিকা কবীরের ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ বইটি নেই। ঘরে ঘরে রান্না মানে এখনও সিদ্দিকা কবীরের রেসিপি। মানুষ তাকে ভোলেনি, মনে রেখেছে। বাঙালি রান্না যতদিন থাকবে, ততদিন তাকে চাইলেও ভোলা সম্ভব নয়। মিডিয়া ভুলে গেছে তাকে, যেভাবে প্রয়োজন ফুরোলে ভোলে সবাইকে।

সিদ্দিকা কবীর আমার মা’য়ের মতো ছিলেন, যদিও তাকে ‘আপা’ বলে ডাকতাম। মা’য়েরও খুব প্রিয় ছিলেন তিনি, ছিলেন শ্রদ্ধারও। ঈদের দিনটিতে তার কথা খুব মনে পড়ে আমার।

এবার ঈদেও নিজে সেমাই রান্না করবো, প্রিয়জনদের নেমন্তন্ন করবো, শুধু সিদ্দিকা আপা নেই!

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এসএইচএস/পিআর