মতামত

শান্তির ছবি আঁকি আলোর অনির্বচনীয় রেখার রঙে

এখন ঈদ। একটা উৎসব আমেজ। কিন্তু কেমন যেন গেলো গত কয়েকটা দিন।

Advertisement

প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুর কন্যা নিজে বাবার খুনের সংবাদ ফেসবুকে দিয়েছে। ফেসবুকে একরামের কন্যাদের আর্তনাদ এখনো আমাদের চোখ ঝাপসা করে। তবুও দেশে উৎসব আসে, মানুষ উৎসবে শামিল হয়। অনাদি ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলেছে, এর ভিতর দিয়েই এগিয়ে চলেছে সৃষ্টি- এক একটি ধ্বংসের পর আবার সৃষ্টি জাগছে- এক একটি মৃত্যুর ভিতর দিয়ে জাগছে নবতর জীবন।

একরামের মৃত্যুর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাখ্যা আছে। অনেক মৃত্যুর কোন ব্যাখ্যা নেই। কে করেছে কেন করেছে বোঝা যায় না, শুধু আন্দাজ করা যায়। কত যে মৃত্যু হয় অন্ধ তামসিক শক্তি দ্বারা! এরা আলো নেভায়, এরা চোরা পথে ঘুরে, এরা মানুষের ঘরে অন্ধকার ছড়ায়। এদের কাছে সত্য, ন্যায়, ধর্ম, সবকিছুই অর্থহীন।

এদের কথা আলোচনা নাইবা করি, কিন্তু যারা যারা সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত, মানুষের জন্য নিয়ে আসে আলো, যারা ক্ষুদ্র জীবনকে দিতে চায় বিপুল বাঁচার আনন্দ, তারা কি পায়? দুঃখ, লাঞ্ছনা, নির্দয় আঘাত—কখনো দিতে হয় জীবন আহুতি।

Advertisement

আসলে এক জেদ চেপে বসেছে সবার অন্তরে। সবাইকে জিততে হবে– এমন এক জেদ। তিনি যতক্ষণ আমার কথা বলেন, সায় দেন ততক্ষণ তিনি আমার প্রিয়। তার প্রতি সুপ্রসন্ন। আমার কথার বা মতের বাইরে গেলেই আমি আমার অজান্তে রাগ জমা করছি, অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করছি।

প্রশ্নহীন আনুগত্য- রাজনীতি যেমন চায়, চায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজও, ধর্মতো চায়ই। সমাজে বিরুদ্ধমত মাথাচাড়া দিলেই ঠাণ্ডাভাব সরে গিয়ে উত্তপ্ত হতে শুরু করে।

খোলামেলা যুক্তির পরিসর আমাদের প্রত্যাশিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই পরিসরটা এ দেশে প্রায় সর্বত্রই ছোট হয়ে আসছে। অসহিষ্ণুতা আমাদের পুরনো এবং পরিচিত ব্যাধি।

যখনই কেউ বেচাল কথাবার্তা বলেছেন, কোন পক্ষের জন্য অস্বস্তিকর কিছু করেছেন, বরাবর এবং বার বার তাদের দমনের ব্যবস্থা হয়েছে। সমস্ত বিরুদ্ধতা সবলে উপড়ে ফেলবার চেষ্টা চলছে, যুক্তির কোন জায়গা নেই এদের কাছে।

Advertisement

চারদিক থেকে অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। উদারতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। কারও লেখা বা বলা পছন্দ না হলেই তাকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে কোন কোন গোষ্ঠীর কাছে। কেন এই মানসিকতা? কেন এতটা হিংস্রতা? এটা কি আসলে গভীর অনিশ্চয়তায় নিমগ্ন, নিরাপত্তাবোধ হারিয়ে ফেলা একটা সমাজের বিপন্নতার পরিণাম?

একে অন্যের হাত ধরে বেঁচে থাকার সমস্ত আবেগ অতি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি বলেই কি প্রতিহিংসায় এমন প্রবল বিশ্বাস? মনের গভীরে বুঝে নিয়েছি, কোথাও কোনও সংশোধনের অবকাশ নেই, শুশ্রূষার সুযোগ নেই, নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়ে ওঠা একটা পরিবেশে আমরা সম্পূর্ণ অসহায়।

সমাজের এই ক্রমশ বাড়তে থাকা হিংস্রতা আমাদের রাষ্ট্রের পক্ষে খুব সুবিধাজনক। বন্দুক দিয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করে সে। কারণ সমাজের ভেতরই এমন প্রশ্রয় থাকে। সমাজের পরিবেশ বেপরোয়া, সংঘর্ষময় করে তোলার আয়োজন এখন সর্বত্র।

রাতারাতি পরিবর্তন আসবে না। অনেকদিনের জমানো এক বৈশিষ্ট্য এটি। আমাদের ধর্মীয় আবেগ আছে, তার সাথে রাজনীতির যোগ আছে। এই রাজনীতি যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে সুবিধা আদায়ে, তেমনি তার ভেতর আছে দখলদারির মানসিকতা। এর প্রবাহ ঠিকই থাকে, শাসক বদলালেও।

এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে, নিরন্তর বিপন্নতার মধ্যে, প্ররোচনা ও উস্কানির মধ্যে জীবন চালাতে হয়, কথা বলতে হয়। যারা লেখালেখি পছন্দ না হলে কাউকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয় তারা কি কখনো কোন সামাজিক কল্যাণের কাজে উৎসাহ দেয়? জানতে ইচ্ছে করে।

শিক্ষার প্রসারে, শিশুদের রোগ নিরাময়ে এদের দেখা যায়? দেখা যায় না। কারণ এসব কাজে মানুষের মন জয় করা গেলেও তাকে সন্ত্রস্ত করে রাখা যায় না। আর মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে না থাকলে খুনের কাজ যারা করে তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাই দর্শন একটাই - ভয় দেখাও। যেন ভয় দেখানোতেই ধর্মাচরণের স্বাধীনতা।

এক নিষ্ঠুর দর্শন- ভয় দেখিয়ে লোক ক্ষেপাও, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে হুঙ্কার তোলো, তাতিয়ে দাও উগ্রতাকে। অবান্তর, অকিঞ্চিৎকর, প্রান্তিক বিষয়কে সামনে তুলে আনো, মানুষকে জীবন-মরণের খেলায় ফেলে স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীর হাত শক্তিশালী কর। আর রাজনীতি? সেও যেন এই খেলার জন্য অপেক্ষা করে। ধর্মের এক সংগ্রামী মেজাজ আছে। কিন্তু তার সাথে কি মিশবে উদার, সহিষ্ণুতা, স্থৈর্য? উৎসবে এই হোক প্রত্যয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস