কৃষক। যারা দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়। যারা খাদ্য সঙ্কট নিরসনে মূল প্রদায়কের ভূমিকা পালন করে। ধানের চারা রোপণের পর থেকে যারা ধানের কুশিতে কুশিতে স্বপ্ন বুনে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ধান চাষ করে। সেই কৃষকের আশায় গুড়ে বালি পড়ে ধান যখন ঘরে আসে। কৃষক ধানের দাম পায় না- এ কথা প্রত্যেক মৌসুমেই লেখা হয়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকেন কিন্তু সমস্যা সমস্যাই রয়ে যায়। সমাধান আর হয় না।
Advertisement
বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তবমুখী চিন্তা ভাবনা না থাকার কারণে একাধারে ঠকছেন কৃষক ও ভোক্তা। কৃষক যেমন পান না তার পণ্যের ন্যায্যমূল্যে, তেমনি ভোক্তারাও নিষ্পেষিত হন মধ্যস্বত্বভোগীদের চক্রবাকে। এসব বিষয় নিয়ে কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী, নীতি নির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ধানচাষির সুখ-দুঃখ নিয়ে তিন পর্বের একটি ধারাবাহিক রিপোর্ট আজ দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হলো-
বাজারে বর্তমানে ধানের দামের তুলনায় চালের দাম অনেক বেশি। যেহেতু ধানের দাম বাজারে কম, সে হিসেবে চালের দামও কম থাকার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে ধানের দামের তুলনায় চালের দামের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। এছাড়া মফস্বল থেকে ঢাকায় চালের দামের পার্থক্যটা তুলনামূলক অনেক বেশি। কৃষকরা বলছেন, মিল মালিকরা কারসাজি করে ধান কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন, সিন্ডিকেট করেছে। অন্যদিকে মিল মালিকরা দুষছেন চাল আমদানিকারকদের। তারা বলছেন, অতিরিক্ত চাল আমদানির কারণে চাল বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে ধানও ক্রয় করতে পারছেন না। অতিরিক্ত চাল আমদানি কৃষকের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
বগুড়া জেলার ধুনট থানার চরপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী মজিবর জানান, ধুনট বাজারে মোটা চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বিআর-২৮ (মাঝারি চিকন) বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা দরে। মজিবর জানান, এক মণ মোটা ধান ক্রয় করতে খরচ হচ্ছে ৭০০ টাকা। এক মণ ধান থেকে চাল হয় ২৫ কেজি। ফলে প্রতিকেজি চালের বিক্রি মূল্যে ৩২ টাকা হলে ২৫ কেজি চালের দাম পড়ে ৮০০ টাকা। এক মণ ধানে লাভ হয় ১০০ টাকা। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীর আরও লাভ হবে চার কেজি ক্ষুদ এবং ধানের কুড়া। সব মিলিযে এক মণ ধানে ২০০ থেকে ২২৫ টাকা লাভ হয়।
Advertisement
গত শুক্রবার ঢাকায় টিসিবির চালের মূল্যে সর্বোচ্চ ছিল ৫৮ থেকে ৬৬ টাকা। মাঝারি চাল ৪৮ থেকে ৫৪ টাকা আর মোটা চালের দাম ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। আর মফস্বল শহরে চিকন মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে। ফলে টিসিবির বাজার অনুযায়ী মফস্বল শহর থেকে মোটা ও মাঝারি চালে পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে কেজি প্রতি ১০ টাকা। চিকন মিনিকেটেও ১০/১২ টাকা পার্থক্য হচ্ছে।
খাদ্য অধিদফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হিসাবে গত বছরের বন্যায় সর্বোচ্চ ১০ লাখ টন চালের উৎপাদন কম হয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরে সব মিলিয়ে ৩৭ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ৪৫ লাখ টন। এগুলোর এলসি খোলা হয়ে গেছে। আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ও ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা মূলত এসব চাল আমদানি করছেন।
বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির ফলে বিপদে পড়েছেন দেশের প্রায় এক কোটি বোরো চাষী। গত বছর বন্যা ও ধানে চিটার বিপদ এ বছর ছিল না। তবে উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমদানি করা চাল বাজার দখলে রাখায় বোরো চাষিরা হাটে-বাজারে ধান বেচা-কেনা করতে পারছেন না। চালকল মালিকেরাও ধান না কেনায় দাম গেছে পড়ে, ফলে অনেক জেলায় উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের।
চাল আমদানির বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। চাল প্রসঙ্গে মোবাইল ফোনে প্রশ্ন করা হলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই? আপনারা সরাসরি সচিবকে নক করেন কেন? এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’
Advertisement
এর আগে সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ধানের দাম এবং চাল আমদানির বিষয়ে অন্য এক পত্রিকার সাংবাদিককে বলেন, ‘বোরো ধান ওঠার এ সময়ে চাল আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনলে ভালো হতো। চালের আমদানি শুল্ক নির্ধারণের ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমাদের কাছে এ ব্যাপারে মতামত চাইলে অবশ্যই আমরা তিন-চার মাসের জন্য আমদানি শুল্ক আরোপ করার পক্ষে মত দেব।’
গত বছরের মে মাসের শেষের দিকে প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকায়। এবার তা ৬০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় মণপ্রতি ৮৯৬ টাকা। ধানের দাম কম হলেও চাল প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হওয়া এই চালের বেশির ভাগই ভারত থেকে আমদানি করা।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ এক প্রশ্নের জবাবে জাগো নিউজকে বলেন, ধানের দাম কমলেও চালের দাম কমেনি এ কথা সত্য। বোরো ধান ওঠার এই সময়ে চাল আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনলে ভালো হতো। চালের আমদানি শুল্ক নির্ধারণের ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে মতামত চাইলে কৃষকের সুবিধা হয় এমন মতামত দিতাম।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ভালো না। সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চুরি করে অতিরিক্ত চাল আমদানির কারণে অনেক চাতাল ব্যবসায়ী চাল বিক্রি করতে পারছে না। ফলে চাতাল মালিকদের ধান ক্রয়ও থমকে আছে। এ কারণে কৃষকও ধানের দাম পাচ্ছে না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সারাদেশে যেখানে গড়ে মোট দারিদ্র্যের পরিমাণ কমছে, সেখানে দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় দারিদ্র্যের পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে দেশের অর্থনীতিবিদ ও স্থানীয় কৃষকেরাও মনে করছেন, মূলত ফসলের দাম না পাওয়া ওই দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা এ বি আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কৃষক ফসল ফলায় কষ্ট করে তার স্বচ্ছলতা ফেরানোর জন্য। যখন তারা কন্টিনিউ ফসলের দাম না পায় তখন সংশ্লিষ্ট এলাকায় দারিদ্রতা নেমে আসে। উত্তরাঞ্চলে আগে থেকেই গরীব মানুষের সংখা বেশি। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাঁটে দারিদ্র নিরসনে সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। ধান কৃষকের হাতে থাকা পর্যন্ত দাম বাড়ে না। মিল মালিক বা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেলেই ধানের দাম বাড়ে। এ বিষযে সরকারের নজর দেয়া উচিৎ।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (চ.দা) কৃষিবিদ ড. মো. শাহজাহান কবীর চালের দাম প্রসঙ্গে বলেন, সরকার সরাসরি ধান না কেনার কারণে কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না। সরকার চাল কেনে। এ চাল সরবরাহ করে মিলাররা। এখানে মিলারদের কারসাজির কারণে কৃষক ধানের দাম পায় না।
তিনি আরও বলেন, সরকারের হাতে কন্ট্রোল নেই। যে কারণে ব্যবসায়ীরা এলসি করে চাল আনছে। তাদের চাল আমদানি কারণে আমাদের দেশের কৃষক মার খাচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার ৩৮ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন চাল কেনার ঘোষণাও দিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৯২ হাজার টন চাল সরকারি গুদামে ঢুকেছে। আগে থেকে সেখানে ছিল আরও ৯ লাখ টন চাল। ফলে মজুত নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু গোলার ধান হাটে বিক্রি করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রায় এক কোটি বোরো চাষী।
সূত্র মতে, সাধারণভাবে দেশের চাল আমদানির ব্যবসায় খুলনা, যশোরের নোয়াপাড়া, সাতক্ষীরা ও নওগাঁর কিছু ব্যবসায়ী যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী ১০ থেকে ১২টি শিল্প-ব্যবসায়িক গোষ্ঠী চাল আমদানিতে নামে। এ খাতে তারা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণও নেয়।
এ ব্যাপারে দেশের চালকল মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমদানি করা চালের কারণে আমরা চাতাল মালিকরা চাল বিক্রি করতে পারছি না। আমাদের চালের ডিমান্ড নেই। এ কারণে চাতাল মালিকরা ধান কিনতে পারছে না। ফলে ধানের দাম পড়ে গেছে। সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা চালকল মালিকেরা পূরণ করবেন।
এফএইচএস/আরএস/জেআইএম