ঠিক মাঝ রাতেই নতুন করে টানতে হয় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪,০৯৬.৭ কিলোমিটার স্থল সীমানা। শেষ হয় ৬৮ বছরের অপেক্ষার। এ কেবল অপেক্ষার অবসান নয়, বন্দিজীবন থেকে মুক্তিও বটে। এ এক অনন্য মুহুর্ত। মুহুর্তটি নিশ্চিতভাবেই গৌরবের। সেই গৌরব পরিচয়ের। সেই গৌরব জাত্যাভিমানের। তবে এই মুক্তি কি কেবল দেশের ভেতরের আরেকটি দেশের শেকল থেকে? না, সেটা বলা যাবে না। ভূ-রাজনীতির অমানবিক হিসেব-নিকেশে এতদিন যারা দেশের ভেতরে থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিলো দেশ থেকে, কেবল তারাই জানেন এই মুক্তির আনন্দ কতখানি। সবই ছিলো তাদের। ছিলো দেশ, ছিলো ঘর। কিন্তু ছিলো না নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার মর্যাদা। মধ্যরাতের প্রদীপের আলোয় হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করেছে কার্যত দেশহীন মানুষগুলোর জীবন। এখন দেশ আছে, পরিচয় আছে। আছে সবকিছু। আসলেই কি নিজের মতো করে একটি দেশ পেয়েছে ছিটমহলের মানুষরা? ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিলো ৫১টি ছিটমহল। আর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি। এই ছিটমহলগুলোর মানুষ ঠিকই পেয়েছে মুক্ত বাতাসে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা। পেয়েছে নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার। কিন্তু ৪,৬৩৬.৮৫ একর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার কি হবে? সেখানকার তিন হাজার ১৬৫টি পরিবারের জীবনে কি আগস্টের প্রথম প্রহরে নতুন জীবনের কোনো বার্তা উঁকি দিয়েছে? ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি কিংবা এ বছরের ৬ জুন হাসিনা-মোদি চুক্তি। কোনো কিছুতেইতো কিছু হলো না দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায়। তবে কি ২৩ বছর আগেই ১৯৯২ সালের ২৬ জুন লেখা হয়ে গেছে এই ছিটমহলের চূড়ান্ত ভাগ্য? চারপাশে ভারতীয় ভূ-খণ্ডের অবস্থান এমন যাতে চিকন-নেক (chicken neck) এ পরিণত হয়েছে আয়তনের দিক দিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশি এই ছিটমহলটি। এখানকার জীবনযাত্রা এখনো থমকে আছে পাঁচ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে। তিনবিঘা করিডোরেই মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে সূত্র খুঁজে ফেরে এখানকার মানুষ। যে করিডোর পেরোতে এক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থাকতে হতো ছিটবাসীকে তা বাংলাদেশকে লিজ দেয়া হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। তাতে কি মুক্ত জীবনের স্বাদ পেয়েছে দহগ্রাম আঙ্গরপোতার মানুষ? লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানা এলাকা থেকে মাত্রইতো তিন বিঘা ওপারে একখণ্ড বাংলাদেশ। কিন্তু জীবন সেখানে ঠিকই শেকলে বাঁধা পড়ে আছে ৬৮ বছর ধরে।১৯৭৪ সালে স্থল সীমান্ত চুক্তি করেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী। ইতিহাসে যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামেই পরিচিত। কি বলা হয়েছিলো সেই চুক্তিতে? বলা হয়েছিলো, বেরুবাড়ি ইউনিয়নের অর্ধেকটার অধিকার ধরে রাখবে ভারত। বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিকার বাংলাদেশের। সেই চুক্তির আলোকেই পরবর্তী সময়ে তিনবিঘা করিডোরের অনির্দিষ্টকাল ইজারা পায় বাংলাদেশ। সেটাই আপাত বাস্তবসম্মত। ওই তিনবিঘাই যে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাকে যোগ করেছে বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসু সরকার যখন চুক্তির এই অংশটি বাস্তবায়নে সম্মত, তখন বিরোধিতাও হয়েছিলো জোরেশোরে। বিশেষ করে সেখানকার ফরোয়ার্ড ব্লকের তরফ থেকে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ওদেরতো তিনজন নিহতই হয়। এরমধ্যেই ১৯৯২ সালের ২৬ জুন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা নিয়ে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অংশটি কার্যকর হয়।কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী মহল থেকে। সীমান্ত জটিলতা কমিয়ে ছিটবাসীকে সত্যিকারের নাগরিক জীবন দেয়াই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের দোষ কোথায়? ১৬২টি ছিটমহলকে যদি স্খলন (aberration) হিসেবে ধরা হয়ে থাকে তবে একটির ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন নীতি? দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সোয়া সাত বর্গমাইলের। এই অংশ কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া দেয়নি ভারত। কেন বেড়া দেয়া হয়নি সীমান্তের এই অংশে? চুক্তি অনুযায়ী দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাও একদিন সরাসরি ভারতের অধিকারে চলে যাবে- এই চিন্তা থেকেই? পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী মহলের চাওয়াটা যে তেমন তাতে কোনো রাখঢাক নেই। তারাও বলছেন, ভারতের অংশ হয়ে গেলে সেটা ওই এলাকায় প্রায় ৩৪ হাজার মানুষেরই জীবনমানের জন্য ভালো হবে। উপরন্তু তাদের ভয়, অনিয়ন্ত্রিত (!) ছিটমহলটি হয়তো অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নাকি গভীরভাবেই ভাবছেন। এরইমধ্যে ভারতীয় পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপনও করেছেন দার্জিলিং-এর এমপি এস এস আহলুওয়ালিয়া। অথচ এই বিষয়ের সুরাহা হয়ে গেছে বহু আগেই। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেই ছিলো সমাধান। যার বাস্তবায়ন জ্যোতি বসুর সময়ে। তার ধারাবাহিকতাতেই তিনবিঘা করিডোর এখন দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষের জন্য খোলা থাকছে সব সময়। তিনবিঘার মালিকানা বাংলাদেশের না হলেও ইজারা পাওয়া গেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। বন্ধুপ্রতীম দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে সীমান্তসংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে ঢের। সেই আলোকে আশা রাখা যায়, বন্ধুত্বের গতি-প্রকৃতি যেদিকেই যাক না কেন তিনবিঘার ইজারা বাংলাদেশেরই থাকবে। তাই যদি হয়, তবে তো দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বিনিময়ের কোনো দরকার পড়ে না। বরং শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে ওই অঞ্চলটির প্রতি। সেখানকার উন্নয়নে ভালো কিছু পরিকল্পনাও আছে ঢাকার। তাই ৩৪ হাজার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তাদের ভারতের অংশ করার দাবি কিংবা চিন্তা অহেতুক ছাড়া কিছু নয়। ২. নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ভাবনাআগেই বলেছি, ৬৮ বছরের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে ছিটমহলবাসী। ঐতিহাসিক একটি চুক্তির বাস্তবায়ন হলো ৪১ বছর পর। এই ছিটমহুলগুলো নিয়ে নিরাপত্তার একটা শঙ্কা সব সময়ই ছিলো। সেই শঙ্কা যে একেবারেই মিলিয়ে গেলো তা কিন্তু নয়। বরং তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কার ক্ষেত্র। শঙ্কা আছে দিল্লীর তরফ থেকে, সমান শঙ্কা আছে ঢাকার তরফ থেকেও। ভারতে এনিয়ে কেবল খোলামেলা আলোচনাই নয়, তাদের নানা কার্যক্রমেও বিষয়টি স্পষ্ট। বিশেষ করে জেএমবি`র মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যারা পশ্চিমবঙ্গে এরইমধ্যে সক্রিয় তাদের অনুপ্রবেশের বিষয়ে কলকাতার পাশাপাশি দিল্লীও বেশ সজাগ। জাতিগত বিরোধিতর বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। বিভিন্ন সূত্র বলছে, এনিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নাকি মাঠপর্যায়ে ভীষণ তৎপর।ছিটমহল সংক্রান্ত যে সীমান্ত সমস্যা বাংলাদেশ-ভারতের ছিলো তাতে নিরাপত্তা বড় একটি চিন্তার বিষয় বৈকি। কিন্তু সেই চিন্তা বা দুশ্চিন্তা কি কেবলই ভারতের? একই ধরনের নিরাপত্তা হুমকি কি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নেই? জঙ্গি অনুপ্রবেশের ভয় যেমন আছে দিল্লীর, একইভাবে কি ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে ভাবছে না ঢাকা? দীর্ঘদিনের বঞ্চিত জনপদে তথাকথিত ভারত-বিদ্বেষ যদি দিল্লীকে ভাবায় তবে একই ধরনের ভাবনা কেন ঢাকা করবে না? অথচ ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণ দেখলে মনে হবে, ছিটমহল বিনিময়ের পর নিরাপত্তার হুমকি যেন শুধুই ভারতের। বাংলাদেশ যেন কিছুটা ভূমি বেশি পেয়ে বর্তে গেছে।লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভিshahariar@journalist.comএইচআর/এমএস
Advertisement