বিশেষ প্রতিবেদন

ডিভাইস আসক্তিতে বাড়ছে ক্ষতি

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের জোহরা পারভীন শিউলী ও মাহমুদুল হাসান দম্পতির দুই সন্তান। আট বছরের মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে আর সাড়ে চার বছরের ছেলে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে-তে পড়ে। শিউলী একটি বেসরকারি হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা, শুক্রবার ছাড়া সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান ফিরেন রাতে। ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসানকেও ব্যবসার কাজে বেশির ভাগ সময় চট্টগ্রামে থাকতে হয়।

Advertisement

শিউলী-মাহমুদুল দম্পতির সন্তানদের দেখাশোনার ভার মূলত কাজের বুয়ার কাঁধে। স্কুল ছাড়া দুই সন্তান সারাক্ষণ ফ্ল্যাটেই বন্দি থাকে। দু’জনেরই স্থূল শরীর। বাসায় তাদের সময় কাটে মোবাইল-ট্যাবে গেম খেলে বা টিভি দেখে।

শিউলী বলেন, ‘চাকরির প্রয়োজনে বাইরে থাকতে হয়? এর ফাঁকেই বাচ্চাদের যত্ন নেয়ার চেষ্টা করি। কী করব? বুয়াই সব সামলায়। মুক্ত হাওয়ায় খেলাধুলা করার দরকার রয়েছে সেটা বুঝি, কী করার? বাইরে খেলার জায়গা নেই, এছাড়া বাইরে গিয়ে যে খেলবে নিরাপত্তাই বা কে দেবে?’

পিতা-মাতার ব্যস্ততা, লেখাপড়ার চাপ ও খেলার মাঠের অভাবে এভাবে শহরের গৃহবন্দি শিশুদের সময় কাটছে ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনে। মনোবিদ, শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সব দিক রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুরা মোবাইল, কম্পিউটার ও টেলিভিশন দেখে বিনোদনের চাহিদা মেটাচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা এসব ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। এভাবে ডিজিটাল আসক্তি নিয়ে শিশুদের বেড়ে ওঠা অস্বাভাবিক। চোখে সমস্যা দেখা দেয়া, স্থূল হয়ে যাওয়াসহ নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই, কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই। সব কিছুতেই শিশুদের উপর একটা চাপ। লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা যে বিনোদন পাবে সেটা পায় না। এমন শিক্ষাজীবন শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করে। শিশুরা এখন ট্যাব, মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। অনেকভাবে আমরা এর কুফল এখনই ভোগ করছি।’

লালবাগের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার তিন বছরের একটি মেয়ে। এখনও স্কুলে ভর্তি করিনি। সারাদিন বাসাতেই তার সময় কাটে। বাইরে গিয়ে খুব খেলতে চায়, কিন্তু সুযোগ কই? বাসায় বসে টিভি দেখে, মোবাইলে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক ভিডিও নামিয়ে দিয়েছি সেগুলো দেখে। মাঝে মাঝে মেয়েকে লালবাগ কেল্লায় নিয়ে যাই। কেল্লার ভেতরে ঢুকতেই মেয়েটি ভীষণ আনন্দ নিয়ে খোলা জায়গায় ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে চলে। আমরা ছোটবেলায় কত ছুটোছুটি, কাদায় মাখামাখি করেছি, খেলেছি। কিন্তু সেসবের কিছুই পাচ্ছে না সে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) ২০১৫ সালে দেশের সাতটি সিটি কর্পোরেশনে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৪ হাজার ১শ’ শিশুর উপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে, শহরগুলোর ১৪ শতাংশ শিশু স্থূলকায়।

জরিপে শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া এবং দৈনিক কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে খেলাধুলা না করাকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, অনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন দেখা, ট্যাব, মুঠোফোনে ভিডিও গেমস খেলার নেশা শিশুদের বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।

Advertisement

টেলিফোনে পরামর্শ নেওয়ার মাধ্যম সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়নে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক ডা. নিশাত জাহান অরিন বলেন, ‘শিশুরা মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটারে আসক্ত হয়ে পড়লে তাদের মানসিক বিকাশে সমস্যা হতে পারে। যে সময়টায় শিশুর খেলার কথা, শেখার কথা সেই সময়টায় শিশুর চিন্তা ধারা বা বুদ্ধি একটি ডিভাইসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। সে জন্য সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়গুলো সে শিখতে পারে না, শিশু আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। এটা গেল মানসিক বিষয়। শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু। শিশুর চোখ ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব ডিভাইসগুলো থেকে নানা ধরনের রেডিয়েশন বের হয়। শিশু দিনে এক ঘণ্টা এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে খেলতে পারে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি সময় খেললে সমস্যাগুলো হতে পারে।’

যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল কবরস্থান রোডের গৃহিনী শেফালী আক্তার বলেন, আমার মেয়ের বয়স ৬ বছর। প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলে যাওয়া ছাড়া বাইরে খেলতে নিয়ে যেতে পারি না। ওদেরও তো সময় কাটাতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে মোবাইলটা দেই, টিভি দেখতে দেই। কখনও মোবাইল না দিলে, টিভি দেখতে না দিলে কান্নাকাটি করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির এ যুগে শিশু খেলার মাঠের অভাব পূরণ করছে সুদৃশ্য মুঠোফোন, ট্যাব, কম্পিউটার এবং বলাবাহুল্য ইন্টারনেট ইউটিউব আসক্তি দ্বারা। এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জালে জড়িয়ে শিশুরা আসক্ত হয়ে পড়ছে কুরুচিপূর্ণ ভার্চুয়াল গেমে। ফলে পরিবারের সাথে তাদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। অভাব থেকে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের।’

তিনি আরও বলেন, ‘শারীরিক ক্ষতি থেকেও মুক্তি নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে নির্গত রশ্মিদ্বারা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুর চোখ, ত্বক ও মস্তিষ্ক। বেড়ে যাচ্ছে শিশুর স্থূলতা এবং ডায়াবেটিস ঝুঁকি। আর কমছে পড়াশোনায় মনসংযোগের ক্ষমতা।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণ-সাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের পেছনে, গাইড বইয়ের পেছনে দৌড়াতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিনোদনের জন্য একটু স্বচ্ছল পরিবারের শিশুরা কম্পিউটার ইন্টারনেট নিয়ে পড়ে থাকে। এই তো পরিস্থিতি, এটা শিশুদের বিকাশের জন্য স্বাভাবিক নয়।’

এছাড়া এখন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পরিবারে একই সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর চাকরি করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই ঘরে একা হয়ে পড়ছে সন্তান। কোথাও কাজের বুয়া বা নানী-দাদীর কাছে পালিত হচ্ছে সন্তান। এসব শিশুদের বেশির ভাগ সময় কাটে ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক নেহাল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসারের স্বচ্ছলতার জন্য মাও চাকরিতে যাচ্ছেন এখন। সবাই এখন কল্পনা করেন তাদের বাড়ি হবে, ফ্ল্যাট হবে, সন্তানকে ভালোভাবে লেখাপড়া করাবেন। এসব কারণেই মূলত মায়েদেরও চাকরিতে যাওয়া। এতে সন্তানকে বুয়া বা নানী-দাদীদের কাছে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু বাবা-মায়ের পরিচর্যাটা সম্পূর্ণভাবে হয় না। সামাজিকভাবে সে ওইভাবে বিকশিত হবে না, তার মধ্যে কিছু গ্যাপ থেকে যাবে। অনেক কিছু শিশু শিখবে না।’

অধ্যাপক নেহাল করিম আরও বলেন, ‘আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শীর্ষে অবস্থান করছি, এ জন্য এর প্রভাব আমাদের মধ্যে থাকবে। আমরা ডিভাইস নিয়ে এত ব্যস্ত যে, সময় বের করতে পারছি না। শিশুরাও এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তবে সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করতে হলে মাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে।’

আরএমএম/আরএস/জেআইএম