জীবনটা আকাশের মতো। কখনও মেঘ বৃষ্টি, কখনোবা রোদ। এই রোদ ঝড় বৃষ্টির জীবনে সফল হবার জন্য চাই তীব্র মানসিক শক্তি। আর মানসিক শক্তি প্রবল হবার জন্য দরকার সুস্থ দেহ। একটি সুস্থ দেহের মানুষ কাজ করতে পারবেন দ্বিগুণ পরিমাণে, একজন অসুস্থ মানুষের তুলনায়।
Advertisement
প্রতিযোগিতার তীব্র দৌড়ে সফল হবার জন্য প্রয়োজন সুস্থ দেহ। তাই ছোটবেলা থেকেই যত্ন নিতে হবে দেহের। যে কোন যুগান্ত সৃষ্টিকারী সাফল্যের পেছনে নবীনদের অগ্রণী ভূমিকা থাকে, অধিকাংশ সময়ে। দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর ইতিহাসের পাতা সেই নবীনদেরই সাক্ষী দেয় বেশি। যেকোন সমাজ, রাষ্ট্র, জাতিকে সফল হবার জন্য চাই নবীনদের অগ্রণী ভূমিকা।
আর এই জন্য দেহের প্রতি যত্নশীল হওয়াটা ভীষণ জরুরি। দেখা যায়, শিশুদের যত্ন নেয় তাদের বাবা মায়েরা। আর বৃদ্ধরাও পারিবারিকভাবে যত্ন পায়। কিন্তু বঞ্চিত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নবীনেরা। পড়ালেখা, ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে দেহের যত্ন নিতে পারে না। অকালেই আক্রান্ত হয় নানান রকম অসুখে।
তরুণেরা আজকাল অনেক হতাশাগ্রস্থ হলে ঝুঁকে পড়ছে মাদকের দিকে। যা কখনই কাম্য নয়। মাদক সেবনের ফলে একজন যুবকের সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তার পুরো পরিবার। অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য প্রয়োজন দেহের প্রতি যত্নশীল হওয়া।
Advertisement
সুস্থ দেহ থাকলে মানুষ কর্মঠ হতে পারবে। আর কর্মঠ মানুষেরা দূরে থাকে বিভিন্ন রকম অলসতা, অযৌক্তিক আন্ডাবাজি থেকে। প্রতিযোগিতার এই তীব্র দৌড়ে জয়ী হবার জন্য প্রয়োজন অঁটুট ধৈর্য্য আর মনোবল। আর এই জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে সুষম খাবার, বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
শিশু বয়স থেকেই আমাদের সবাই প্রতিযোগিতার তীব্র যাঁতাকলে পিষ্ট। বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে এই প্রতিযোগিতা আরো বেড়েই যাচ্ছে। পরিণামে নবীন বয়সে অধিকাংশ যুবকেরা অকালেই নানান রকম অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে।
সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রচুর নবীন এর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ রোগ। যা কখনোই কাম্য নয়। লেখাপড়া, ক্যারিয়ারের জন্য সবাই এখন ঢাকামুখী। গগনচুম্বী অট্টালিকা, নিত্য নতুন অফিস আর বিল্ডিং এর জন্য হারিয়ে যাচ্ছে মাঠ, পুকুর, পার্ক। পরীক্ষাতে উচ্চ মার্কের সনদ পাবার জন্য আজকের নবীনেরা খোলা আকাশের চেহারা দেখার সময় পায় না। বুক ভরে নেয়ার সময় পায় না মুক্ত বাতাসের।
ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ার টেবিল আর কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হচ্ছে। এতে দৈহিক পরিশ্রম সঠিকভাবে হচ্ছে না। আর নির্দিষ্ট পরিমাণ গাছপালার অভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের জন্য মানুষ কম বয়সেই শিকার হচ্ছে বিভিন্ন রকম অসুখের।
Advertisement
আর দৈহিক পরিশ্রমের অভাবে সারাক্ষণ বই আর ল্যাপটা নিয়ে বসে থাকা ছেলে মেয়েরা অকালেই রক্তে বাড়িয়ে ফেলছে চিনির মাত্রা। এতে নিজের অজান্তেই অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছে ডায়াবেটিস। বিশেষত বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী যাদের ওজন অনেক বেশি। আর ভেজাল খাবারের প্রভাবতো রয়েছেই। তাই খেয়াল রাখতে হবে, যেন বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বেড়ে না যায়।
শত ব্যবস্তার ফাঁকেও চেষ্টা করতে হবে এই সমস্যাগুলো দূর করার। তরুণ বয়সে যারা মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম ও অনিয়ম করে, তারা আক্রান্ত হচ্ছেন গল ব্লাডারের স্টোন বা পিত্ত থলির পাথরে।
দীর্ঘ সময় যাবৎ না খেয়ে থাকলে আর বছরের পর বছর খাবার অনিয়ম করে খেলে, পিত্তথলির পিত্তরস ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তখন তৈরী হয় গল ব্লাডারে পাথর। এই পাথর তৈরি হয় শুধু খাবারে অনিয়মের জন্য নয়। ভেজাল খাবার, রক্তে চর্বির মাত্রা বৃদ্ধি (বিশেষত দৈহিক শ্রমের অভাবে), পারিবারিক কারণেও হতে পারে। কয়েক বছরের তুলনায় এখনকার তরুণদের ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার, গল ব্লাডার আর কিডনীতে পাথর এর পরিমাণ বেশি।
প্রতিযোগিতার তীব্র যুদ্ধে নিজের দেহের প্রতি মনোযোগের অভাবে, মানুষ ঝুঁকে পড়ছে বেশী ল্যাপটপ আর বাসার বাহিরের খাবারের প্রতি। এতে রক্তে ভেজাল খাবার (বিশেষত যা ভেজাল তেলের জন্য প্রধানত দায়ী) এর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যা বাড়িয়ে দিচ্ছে ওজন, পরিণামে রক্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে ফ্যাট ও কোলস্টেরলের মাত্রা। এই মাত্রাগুলো কমিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন দেহের বাড়তি চর্বি ও চিনির পরিমাণ হ্রাস করা। চাই প্রচুর পরিমাণে দৈহিক পরিশ্রম। কিন্তু হাঁটাহাঁটির জায়গার বড়ই অভাব।
পরিণামে বসত বাড়ি হয়ে উঠছে আরো বেশি ছোট। দৈহিক পরিশ্রমের অভাব আর ভেজল খাবারের জন্য মানুষের দেহে বেড়ে যাচ্ছে চিনির পরিণাম। আর বংশগত ইতিহাসও এই জন্য দায়ী। যাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার রয়েছে, তারা সচেতন হবেন আরো বেশি। কারণ বংশগত কারণ বা পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, ডায়াবেটিস হাই ব্লাড প্রেসার, এই অসুখগুলো বাসা বাঁধে আরো বেশি।
তাই এখন থেকেই মনোযোগী হয়ে যান নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি। আপনি তরুণ বয়সে যত বেশী কর্মঠ হবেন, তার প্রতিদান আপনি সারা জীবন পাবেন।
এই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত টাটকা খাবার। যতোটা কম মশলা মুক্ত, বাসার খাবার হয়, ততোই ভালো।
আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা এক চেটিয়া বাসার বাহিরে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। প্রচুর ছেলে মেয়ে টিউশনি আর খণ্ডকালীন চাকরি করে। এইভাবে অনেক ছেলে মেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে ফাস্ট ফুডে। যা দেহের জন্য খুব ক্ষতিকর। কারণ এই খাবারগুলো তৈরী হয় মাখন, পনির, নানান রকম মশলা দিয়ে। যা খুব দ্রুত দেহের ওজন বাড়ায় এবং রক্তে বাড়ায় চর্বির মাত্রা। এই অবস্থা বছরের পর বছর হতে থাকলে, বেড়ে যাবে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপের পরিমাণ। যা ঘুণে ধরা পোকার মতো আক্রান্ত করবে পুরো দেহকে। মানুষের দেহ বিশাল একটি কারখানার মতো। এর একটি অংশ নষ্ট হয়ে গেলে অন্য অংশটি দুর্বল হয়ে যায়। তাই খেয়াল রাখতে হবে, যেন পুরো দেহ সুস্থ্য সবল থাকে।
বর্তমানে আমাদের তরুণ সমাজকে অনেকাংশে প্রভাবিত করছে মাদক। আকাঙ্খার জায়গাতে বঞ্চনা, অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা এমন নানান কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে যুব সমাজের বিশাল একটি অংশ। পরিণামে ঝুঁকে পড়ছে বিভিন্ন রকম মাদকের দিকে। মাদকের জন্য অর্থ যোগান দিতে যেয়ে যুব সমাজের বিশাল একটি অংশ জড়িয়ে যাচ্ছে অনৈতিক কাজে। যা পরিবার, দেশ, সমাজ, পুরো জাতির জন্যই ভয়ানক হুমকি স্বরূপ।
এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছোটবেলা থেকেই প্রার্থনা বা ধ্যানের অভ্যাস করা, ভাল ভাল বই পড়া, পরিবারের সবার উচিৎ শিশু বয়স থেকেই সৃজনশীলতাকে ফুটিয়ে তোলা। এই ভালো লাগার কাজগুলো শিশু থেকে যুবক বয়সে চলতে থাকলে, যুব সমাজের মধ্যে সৃজনশীলতা আরো বাড়বে। পরিণামে হতাশার মধ্যে মানুষ সৃজনশীল কাজের প্রতি ঝুঁকবে বেশি, যুব সমাজে কমে আসবে মাদকের পরিণাম।
যুব সমাজ যে দেশের যতো তৎপর, সেই যুব সমাজের উচিৎ, নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। পাশাপাশি সৃজনশীল বা গঠনমূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করা।
মানুষের জীবন সিঁড়ির ধাপের মতো। প্রথম দিকের ধাপগুলোতে সঠিক পদক্ষেপ ও দিক নির্দেশনা থাকলে, পরবর্তী জীবনে সফল হবার সম্ভাবনা থাকলে ততোই বেশি।
যুব সমাজ একটি জাতির হাতিয়ার। সফলতার এই হাতিয়ার হোক প্রাণচঞ্চল ও কর্মব্যস্ত।
লেখক : চিকিৎসক।
এইচআর/আরআইপি