বিশেষ প্রতিবেদন

পড়ার চাপে দিন কাটে আনন্দহীন

* শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয় * পরীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থা* পাঠ্যপুস্তকে এনসিটিবির অননুমোদিত বইও

Advertisement

ফৌজিয়া আফরোজ, বয়স পাঁচ বছর। যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকার হলি চাইল্ড প্রিপারেটরি স্কুলে গত জানুয়ারি মাসে প্লে-তে ভর্তি হয় সে। ফৌজিয়াকে সাতটি বই পড়তে হয়। বইগুলো হলো- ছোটমণিদের ধারাপাত ও অঙ্ক শেখা, ছোটমণিদের বাংলা বর্ণ শেখা, স্ট্যান্ডার্ড এ বি সি, হিউম্যান নার্সারি রাইমস, ছোটমণিদের আরবি বর্ণ শেখা, হিউম্যান ছড়ার মেলা ও ছোটমণিদের আঁকতে শেখা।

ফৌজিয়ার মা আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘এতটুকু শিশু, সাতটি বই। প্রচণ্ড চাপ। দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই টেনশন কখন হোমওয়ার্কটা শেষ করে ফেলব। আমাদের ছোটবেলাটা এমন ছিল না।’

লেখাপড়ার চাপে পড়ে নগরের শিশুদের জীবন এখন অনেকটাই আনন্দহীন। সকালে ঘুম জড়ানো চোখে শিশুকে বইয়ের বোঝা নিয়ে ছুটতে হয় স্কুলের দিকে। স্কুল শেষ করে রাত অবধি চলে কোচিং, স্কুলের পড়া তৈরি।

Advertisement

এ ছাড়া ভালো ফলের জন্য অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করছেন। যে কোনোভাবে সন্তানের কৃতিত্বপূর্ণ ফল চান বাবা-মায়েরা। চতুর্মুখী চাপে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব-কৈশোর।

রাজধানীর ওয়ারীর বাসিন্দা শিউলী আক্তারের মেয়ে ‘ও’ লেভেলে এবং ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ যুগ। ভালো রেজাল্ট করেও অনেক সময় পিছিয়ে থাকতে হয়। সবকিছু বিবেচনা করে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। এখন একটু কষ্ট করলে, চাপ নিলে, ভবিষ্যতে ওরা ভালো থাকবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয়। পরীক্ষা ও পাঠ্যবই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ শিশুর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকার নির্ধারিত পাঠ্যবই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে একটি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনটি, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয়টি, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত ১৪টি এবং নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ১৮ আর মানবিক ও বাণিজ্য শিক্ষার্থীদের ১৭টি বই নির্ধারণ করে দেয়া আছে।

Advertisement

‘ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সট বুক বোর্ড অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩’ এর ১৫ ধারা অনুযায়ী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পড়াতে পারবে না। কিন্তু স্কুলগুলো ইচ্ছামতো বই নির্ধারণ করে পড়াচ্ছে।

যেসব শিশু বইয়ের ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে তার ওজন শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না

তবে বিভিন্ন শ্রেণিতে সরকার নির্ধারিত এই পাঠ্যবইও বেশি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। এই প্রেক্ষাপটে গত ৩১ মে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় চলতি বছরের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (জেডিসি) বিষয়-নম্বর কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেএসসিতে এখন মোট সাতটি বিষয়ে ৬৫০ নম্বরের পরীক্ষা হবে। বর্তমানে চতুর্থ বিষয়সহ ১০টি বিষয়ে মোট ৮৫০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। অন্যদিকে জেডিসিতেও ২০০ নম্বর কমিয়ে ৯৫০ নম্বর করা হয়েছে।

অপরদিকে দেখা গেছে, কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন স্কুলে এনসিটিবির বইয়ের বাইরে কমপক্ষে দুই থেকে ১০টি পর্যন্ত বেশি বই পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হচ্ছে।

যেসব শিশু বইয়ের ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, এর ওজন বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না। শিশুর ওপর বাড়তি বইয়ের বোঝা না চাপানোর জন্য এর আগে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয়। পরীক্ষা খুব বেশি। প্রচুর বই, এত বইয়ের দরকার নেই। ক্লাসরুমে পড়াশোনা হচ্ছে না। তাই কোচিং সেন্টারে যেতে হচ্ছে। গাইড বই কিনতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো এভাবে কোচিং সেন্টার দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশে নেই। এই কোচিং শিশু-কিশোরদের ওপর এক ধরনের অত্যাচার। এমন শিক্ষাজীবন শিশুদের সুস্থ বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেকভাবে আমরা এর ফলও এখন ভোগ করছি। মাদকাশক্তি, জঙ্গিবাদ- এসবই তো সুস্থ মানসিক বিকাশ না হওয়ার কুফল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থার পাষাণভার শিশুর খেলার সময় কেড়ে নিয়েছে। একেবারে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে স্কুলে যাওয়া, ঘরে ফেরা, হোমওয়ার্কের হ্যাপা (ঝক্কি) সামলানো বা গৃহশিক্ষকের দুয়ারে হাজিরা দেয়া। আর সবার ওপরে রয়েছে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী কোচিং সেন্টারের প্রতি আসক্তি, যা যুগের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাধি। এর ভয়াল গ্রাসও কেড়ে নিচ্ছে শিশুর স্বাধীনতা, অবসরের সময়।’

কামাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো পাঠ্যক্রম তো আছেই, সেইসঙ্গে নেই খেলার পরিবেশ, প্রশস্ত মাঠ কিংবা পাঠসহায়ক নির্মল বিনোদন ব্যবস্থা। শহুরে বিদ্যালয়গুলোতে সুদৃশ্য বহুতল ভবন থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে খেলার মাঠবিহীন আলোবাতাস রুদ্ধ পরিবেশ। এতে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরবর্তী জীবনে তা নানা প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে মূলত পরীক্ষার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। তাদের কোচিংয়ের পেছনে দৌড়াতে হয়, গাইড বইয়ের পেছনে দৌড়াতে হয়। খেলার সময় নেই। একটা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষার্থীদের স্কুলে, ঘরে, বাইরে শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তৈরি করা হয়। সেখানে অন্যদিকে দৃষ্টি দেয়া হয় না।’

শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রয়োজন খেলাধুলা, কিন্তু এভাবে খেলার মতো সময় নেই এখনকার শিশুর

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে গবেষণা না থাকলেও পৃথিবীব্যাপী গবেষণা আছে, শিশুরা স্কুলে পুথি-পুস্তকের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে মেধা ও মননের বিকাশ ভালোভাবে হয় না।’

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাঠপুস্তক নির্ধারণ করে আমরা প্রতি বছর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তো বলে দিচ্ছি- এনসিটিবি অনুমোদিত বই ছাড়া কোনো বই পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো যাবে না। শিশু-কিশোরদের সবদিক বিবেচনা করেই আমরা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করি।’

তিনি বলেন, ‘যারা নিয়ম মানছেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার এনসিটিবির নেই। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে। মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে ভাবছেও।’

বলা হচ্ছে, কোনো কোনো শ্রেণিতে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক বেশি হয়ে গেছে- এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘সেটাও আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষার নম্বর কমানো হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক আরও কমিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা আছে, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের বোঝা কমানো। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক পর্যায়ক্রমে আমরা এটা করব।’

অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরাম’-এর সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের লেখাপড়ার চাপ কমানোর জন্য হাইকোর্ট থেকে একটি রুল জারি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীও শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা না চাপানোর জন্য বলেছেন, কিন্তু কে শোনে কার কথা। যে যেভাবে পারছে সে সেভাবে চলছে। আমরা হতাশ। অনেক আন্দোলন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘শিশুদের বই বেশি থাকলে ব্যাগের ওজন বেশি হচ্ছে, এতে শিশুর শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া বেশি বইয়ের কারণে লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশুরা এখন লেখাপড়াকে ভয় পায়, লেখাপড়া থেকে আনন্দটা হারিয়ে গেছে। আমরা শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন চাই।’

শিশুদের অতিরিক্ত চাপের জন্য একশ্রেণির অভিভাবকদের দায়ী করে জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘অভিভাবকদের মধ্যে এমন একটি মানসিকতা তৈরি হয়েছে যে, আমার বাচ্চা যদি এ-প্লাস না পায় আমি মনে হয় সমাজেই থাকতে পারব না। তিন-চার জায়গায় বাচ্চাকে কোচিং করাতে হবে, না হয় ভালো ফল করবে না। মা-বাবা বলেন, অমুকের বাচ্চা এ-প্লাস পেয়েছে, আমার বাচ্চা পাবে না কেন? এই মানসিকতা আমাদের আগামী প্রজন্মের বিকাশে ক্ষতি করছে।’

আরএমএম/জেডএ/জেআইএম