জাতীয়

যেখানে মৃত্যু নামে নীরবে

রাঙ্গামাটি রেডিও স্টেশন পাহাড় আর ভেদভেদি পোস্ট অফিস পাহাড়ের মাঝখানে ছোট্ট উপত্যকায় গড়ে উঠেছে ভাগ্যহত প্রায় তিন হাজার মানুষের বসতি। এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। কিন্তু প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। তাই এখানে মৃত্যু নেমে আসে নীরবে, মানুষের ঘুমের ঘোরে। এক বছর আগে এই নতুন পাড়াতে যেন নেমে এসেছিল খোদ মৃত্যুদূত। এক লহমায় কেড়ে নিয়েছিল অন্তত ৫০টি প্রাণ।

Advertisement

সেই ঘটনার পর বছর পেরুতে এখনও ২৪ ঘণ্টা বাকি, কিন্তু মৃত্যুদূত আসতে দেরি করেনি এবারও। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মা-ছেলেসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে।

২০১৭ সালের ১৩ জুনের বিপর্যায়ে, রাঙ্গামাটিতে প্রায় ১২০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। কেউ হারিয়েছেন স্ত্রী-সন্তান, কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা কেউবা ভাই-বোন। কোনো কোনো পরিবারের কেউই বেঁচে নেই আর। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে রাঙ্গামাটি শহরের উপকণ্ঠে। সেখানে পাহাড় ধসে মারা যায় পাঁচ সেনা সদস্যসহ ৭৩ জন। এর বাইরে কাউখালী উপজেলায় ২১ জন, কাপ্তাইয়ে ১৮ জন, জুরাছড়িতে ছয়জন ও বিলাইছড়ি উপজেলাতে দুজন নিহত হন। এছাড়া এ ঘটনায় আহত হন সর্বমোট ১৯২ জন।

২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙ্গামাটির নতুনপাড়ার এই জায়গায় পাহাড় ধসে নিহত হন একই পরিবারের ৭ জন।

Advertisement

গত বছরের ১৩ জুন রাঙ্গামাটি শহরের প্রবেশদ্বার মানিকছড়িতে পাহাড় ধসে বন্ধ রাস্তা চলাচলের উপযোগী করতে গিয়ে পাঁচ সেনা সসস্য নিহত হন। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য সরাসরি দেখেছেন মানিকছড়ি আর্মি চেকপোস্টে কর্মরত আনসার সদস্য আবুল বাশার।

সেই দিনের মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা জাগো নিউজকে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার (১৩ জুন) ভোরে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্পের পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন এই চেকপোস্টে বসা। সকাল ১০টার দিকে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। মানুষের উপকারে যে মানুষগুলো এসেছিল তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি, সেই পাহাড়ের শিকার হতে যাচ্ছেন তারা।’

আবুল বাশার বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে রাস্তার ওপরে ভেঙে পড়ে আর্মি ক্যাম্পের পাহাড়ের বিরাট একটি অংশ। পাহাড়ের ওই অংশটি নিচে রাস্তায় উদ্ধারকারী দলের ওপর ধসে পড়লে তারা মূল সড়ক থেকে ৩০ ফুট নিচে পড়ে যান। পরে আমরা সবাই মিলে পাঁচজন সেনাসদস্যকে নিহত এবং ১০ জন সেনাসদস্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করি। এটি আমারা জীবনের একটি ভয়াল অধ্যায়। যা কখনো ভুলতে পারবো না।’

রাঙ্গামাটি বেতার স্টেশনের পাশে নতুনপাড়া এলাকা, গতবছরের ১৩ জুন পাহাড় ধসে এই এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হয়েছিল অন্তত ৫০ জন।

Advertisement

পাহাড়ে স্মরণকালের সেই ভয়াবহ বিপর্যায়ের পর উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ আনসারের সদস্য আলমগীর হোসেন। সেই ভয়াল অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এই দুই হাতে ৩৬টি লাশ উদ্ধার করেছি। নিহতের তালিকায় এমন অনেক পরিবার যাদের সবাই মারা গেছেন অথবা এক বা দুজন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু যেখানে বাড়ি ভেঙে পড়েছিল সেখানেই আবার বসবাস শুরু করেছে নিহতের স্বজনরা। তারাও জানেন ওখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু গরিব মানুষগুলোর যাবার জায়গা নেই, তাই নিশ্চিত মৃত্যুকে ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে তারা।’

ভেদভেদি নতুন পাড়া এলাকায় গত বছরের ১২ জুন পাহাড় ধসে মারা যান অটোরিকশা চালক নবী হোসেন ও তার স্ত্রী-কন্যাসহ ছয়জন। বেঁছে আছেন তার এক সন্তান সুমন ও মেয়ের জামাই রুবেল।

২০১৭ সালের ১৩ জুন লাশের স্তূপ পড়েছিল আনসার ক্যাম্পের এই ছাউনিতে।

সব হারানো সুমন জাগো নিউজকে ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এবারের মতো তখনও রোজা ছিল। ১২ জুন রাতে সবাই নিশ্চিন্তেই ঘুমাই, মাঝরাতে সবাই একসঙ্গে সেহেরি করি। পরে আমি এবং আমার দুলাভাই পাড়ার শেষ মাথায় গিয়েছিলাম পাহাড় থেকে পানি কেমন নামছে তা দেখতে। কিন্তু আমার ঘরেই যে পাহাড় ভেঙে পড়বে তা কল্পনাও করিনি। সেহেরির ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে বাড়ির দিকে দৌড়ে আসতে আসতে দেখি সব শেষ।’

সুমন জানান, এখন আর ওই মৃত্যুপুরিতে তিনি থাকেন না। শহরের অপর পাশে তবলছড়ি এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়েছেন।

এদিকে রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুমনদের বাড়ি যে জায়গায় ছিল তা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। তবে এখনও সেই ঘাতক পাহড়ের কোল ঘেষে রয়েগেছে দুটো বাড়ি। সুমনরা চলে গেলেও চলে যায়নি একই দুর্ঘনটায় ক্ষতিগ্রস্ত পাশের বাড়ির বাসিন্দা অটোরিকশা চালক আবদুল খালেক। সেই একই স্থানে আবারো গড়ে তুলেছেন নতুন টিনের ঘর।

নতুন পাড়ার বাসিন্দা ইতিময় বড়ুয়া জাগোনিউজকে বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনার পর এখনও পাহাড়ের দিকে তাকালে ভয় লাগে। তবুও পরিবার পরিজন নিয়ে এখানেই আছি। কোথায় যাব। আমাদেরতো আর অমন সামর্থ নেই যে, শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকবো।’

দুর্গম পাহাড়ে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি।

একসঙ্গে সাতজন মারা যাওয়ার স্থানটি দেখিয়ে ইতিময় বলেন, ‘দেখেন না, সুমনের সবাই মারা গেছে, সরকার তাকে সিএনজি দিয়েছে। সে বাবার ভিটে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু খালেক মামাতো কোখাও যেতে পারেননি। তাই নতুন ঘর করে এখানেই থাকার স্বপ্ন দেখছেন।’

শুধু সুমন কিংবা আব্দুল খালেকের জীবনে নয়, সেবারের পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটি সদরের ভেদভেদির নতুন পাড়া, সনাতন পাড়া, উলুপাড়া, মোনোঘর, কিনামনি ঘোনা, যুব উন্নয়ন, শিমুলতলীসহ অনেক স্থানেই ঘটে বিয়োগান্তক ঘটনা।

কিন্তু গত বছর যেসব এলাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যুসহ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেখানে নতুন করে বসতি তৈরি হয়েছে। পাহাড়ের ওপরেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাগানো হয়েছে ‘পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বসবাস করা নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড। কিন্তু সেই নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই সাইনবোর্ডের লাগোয়া বেশকয়েকটি কাঁচা ও আধাপাকা ঘর গড়ে উঠেছে।

পাহাড়ের বাসিন্দা গৃহবধূ ঝিনুক। গতবারের পাহাড় ধসে তার ঘর ভেঙে গিয়েছিল। যিনি এবারও বৃষ্টি শুরুর পর পাহাড় ধসের ঝুকিতে রয়েছেন।

ঝিনুক বলেন, ‘গতবছর পাহাড় ধসের পর সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রায় তিনমাস আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর একবস্তা চাল আর এক হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। পরে প্রায় ছয় মাস ভাড়া বাসায় থেকে পঁচিশ হাজার টাকা ঘরভাড়া দিয়েছি। এবার আর সেই সামর্থ নেই। তাই মরতে হলে এখানেই মরবো। তবুও পাহাড় ছেড়ে যাব না।’

দুর্গম পাহাড়ে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে আমাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে, ঘর ভেঙেছে। কিন্তু লাভ হয়েছে তথাকথিত নেতাদের। আমরা যারা পাহাড়ের ভেতর আছি তারা কিছুই পাইনি। যত ত্রাণ এসেছে তা শহরের রাস্তাতেই শেষ হয়ে গেছে।’

রাঙ্গামাটি শহরের উপকণ্ঠে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা উলুপাড়া। গত বছরের ১৩ জুন পাহাড় ধসে এখানে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। রোববার দুপুরে বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে উলুপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় ওই গ্রামের সবার চোখেই এক অজানা আতঙ্ক। অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে গেছেন। আবার অনেকে একত্রিত হয়েছেন ‘টং’য়ে।

রাঙ্গামনি নামে এক যুবক জানান, বৃষ্টি আসলেই সবায় আতঙ্কের মধ্যে থাকেন তারা। তবে শহর থেকে দূরে হওয়ায় তাদের যাবার কোনো জায়গা নেই। আবার অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে রাজি নন।

দুর্গম পাহাড়ে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি।

এত ঝুঁকি নিয়ে কেন এই পাহাড়ে থেকে গেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে উলুপাড়ার বাসিন্দা যুদ্ধবধি চাকমা বলেন, ‘কোথায় যাব? বাপ-দাদা এই পাহাড়ে বসবাস করে এসেছেন। আমরাও আছি। মরণ এলে এখানেই মরতে হবে। যাবার কোনো জায়গা নেই। গত বছর আমার দুই আত্মীয় পাহাড়চাপায় মারা গেছে। সূচনা ও সুকেন। কলেজে পড়তো। ১৩ জুন সকালে পাহাড় চাপায় মারা গেছে তারা। বেচারারা সুদূর মাইনি থেকে কলেজে পড়তে এসেছিল। এখন বৃষ্টি এলেই সবাই পাড়ার সবচেয়ে বড় বাড়িটাতে আশ্রয় নেই।’

এদিকে শুক্রবার থেকে ভারী বর্ষণের পর রোববার (১৩ জুন) দুপুরে শহরের উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় দেয়াল ধসে পড়ে। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারী বর্ষণে রাঙ্গামাটি শহরের চম্পকনগর, শিমুলতলি, ভেদভেদি ও কলেজ গেট এলাকায় বেশ কয়েক স্থানে পাহাড় ধস হয়েছে। অপরদিকে ঘাগড়ার শালবন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি রাস্তায় পড়লে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ দীর্ঘ দুই ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়।

দুর্গম পাহাড়ে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি।

আবহাওয়া দেখে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসন লোকজনদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে রোববার সকাল থেকে মাইকিং করেছে। এ ছাড়া রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক রোববার মধ্যরাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরে যেতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। তার আহ্বানের পর রাতে অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও পাহাড়ের পাদদেশে রয়ে গেছেন অনেকেই।

রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবারের মতো ঘটনা যাতে এবার আর না ঘটে তার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে যে কোনো সময় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সবাইকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান করছি।’

এমবিআর/পিআর