ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়ে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন, প্রকাশ্যে, আলাপে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ম্যাজিস্ট্রেসি অভিযান শুরু হয়েছে রমজানের প্রারম্ভে, দেশব্যাপী। কি প্রাপ্তি এই অভিযানে? কল্পনারও বাইরে থাকা ‘মানসম্পন্ন’ এবং ‘দামি ব্রান্ডগুলোর’ হাল হকিকত জানা হচ্ছে এবারের অভিযানে। একটু চোখ বুলাই-
Advertisement
২৩শে মে রাজধানীর শান্তিনগরে মিনা সুপারশপে অভিযান চালায় ডিএমপি ও বিএসটিআইএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় সিটি করপোরেশন নির্ধারিত দামের সাথে গরু ও খাসির মাংসের দামের অমিল থাকায় ১লাখ টাকা ও অনুমোদন ছাড়া বিএসটিআই এর লোগো ব্যবহার করে অনুনোমদিত পণ্য বিক্রির দায়ে জরিমানা করা হয় আরও ১ লাখ টাকা।
একই দিনে ধানমন্ডিতে কেএফসিকে অপরিশোধিত পানি ও তেল ব্যবহারের অভিযাগে ১ লাখ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং কাপড়ের রং খাবারে মেশানোর দায়ে মেজবান রেস্তোঁরাকে ৪লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাব ও বিএসটিআই এর ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গণমাধ্যমে প্রকাশ - নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম জানান, 'কেএফসিতে পানি ফিল্টারিং কাজ করছে না। ফলে লোকজন নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার কারণে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হতে পারে। আর মেজবান রেস্তোঁরায় জর্দায় যে রং ব্যবহার করা হচ্ছে, তা টেক্সটাইল বা কাপড়ে ব্যবহার করা রং। যার কারণে মানুষের ক্যান্সার হতে পারে।'
Advertisement
বুঝুন অবস্থাটা! দেশি-বিদেশি কোনটিই বা তাহলে আস্থার জায়গা থাকলো? আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোও কিন্তু যথেষ্ট নামী এবং দামি। আরো দেখা যাক - এমাসেই ৬ তারিখে পরিচালিত আরেক অভিযানে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং মিষ্টি তৈরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ ও কেমিক্যাল যুক্ত ছানা ব্যবহারের দায়ে একটি কারখানাকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা এবং ১১ মণ মিষ্টি ধ্বংস করা হয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে মিষ্টি তৈরির একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে এই অভিজ্ঞতা হয় র্যাবের। যেখানে স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা পরিবেশে মিষ্টি তৈরি ছাড়াও মিষ্টি তৈরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ ও ক্যামিকেল যুক্ত ছানা ব্যবহারের প্রমাণ পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া, পচা-বাসি মিষ্টি সংরক্ষণ করে ভালো মিষ্টির সাথে চালিয়ে দেয়ারও প্রমাণ মেলে। পরবর্তী সময়ে যা সরবরাহ করা হতো শহরের নামীদামী বিভিন্ন দোকানে।
৯ তারিখের খবর। রাজধানীর বেইলি রোডে নামকরা শো রুম ইনফিনিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এছাড়া অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার তৈরির দায়ে গুলশানের পূর্ণিমা রেস্টুরেন্টকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত।
একই দিনে বেইলি রোডের নবাবী ভোজকে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার তৈরির দায়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ইনফিনিটি শো রুমে অভিযান চালিয়ে লরিয়েলসহ স্টিকারবিহীন বিপুল পরিমাণ বিদেশি ব্র্যান্ডের কসমেটিকস রাখা এবং কর ফাঁকির অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
Advertisement
ঐ দিনেই আন্তর্জাতিক চেইন রেস্টুরেন্ট ফিশ অ্যান্ড কো-কে পচা সবজি, মাছ রাখার দায়ে পাঁচ লাখ এবং আরেক অভিজাত রেস্টুরেন্ট বাটন রুজকে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এই বাটন রোজে খাবারের শেলফে জুতাও পাওয়া গেছে।
বাদ নেই রমজানের অন্যতম খাদ্য খেজুরও। খবরে প্রকাশ গত মাসের ১৭ তারিখে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ফলের আড়তে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ পচা খেজুর জব্দ র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মোট পঞ্চাশ বস্তা নষ্ট খেজুর জব্দ করে র্যাব। চকবাজারই বা বাদ যাবে কেনো? এ মাসেই রাজধানীর চকবাজারের ইফতার মার্কেটে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ডিএমপি’র ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত ৯২ হাজার টাকা প্রদান জরিমানা করেছে। সেই সাথে জেল প্রদান করা হয়েছে আরেক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে।
ঘটনা কি? ডিএমপি নিউজ জানাচ্ছে, পবিত্র রমজান মাস জুড়ে চলমান ডিএমপি’র বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে ৪ জুন ডিএমপি’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান এর নেতৃত্বে ডিবির একটি দল রাজধানীর চকবাজার ইফতার মার্কেটে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন।
অভিযানে চকবাজার ইফতার মার্কেটের বড় বাপের পোলায় খায় দোকানের মালিক মো. হোসেন (৪৫) কে পোড়া তেল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ইফতার তৈরি ও পরিবেশনের অভিযোগে বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই অপরাধে চকবাজার ইফতার মার্কেটের মিম শাহী মোরগ পোলাও রেস্তোরাঁর মালিক আবুল কালাম (৩০) কে দশ হাজার টাকা, ফুটপাতের ইফতারি দোকানদার শহীদ (৬৫) কে দশ হাজার টাকা, বিসমিল্লাহ কাশ্মিরী কাবাব অ্যান্ড বিরিয়ানীর মালিক আবিদ (৩৫)কে পঞ্চাশ হাজার টাকা ও ফুটপাতের মোদাচ্ছের (৪০)কে পঁচা খেজুর বিক্রির দায়ে দুই হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করে।
এদিকে আমানিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট এর মালিক আব্দুর ছাত্তার সরদার (৪৫) কে দোকানে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় তিন মাসের জেল প্রদান করা হয়। এ মাসের ৬ তারিখে পরিচালিত আরেক অভিযানে পাওয়া গেছে ফ্রিজ ভর্তি মৃত তেলাপোকা। গুলশান-২ এ ‘নামী রেস্তোঁরা’ টপ কাপিতে র্যাব ও ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালে সেগুলোর হদিস মেলে।
পরিদর্শনের সময়ে টপ কাপি রেস্টুরেন্টে এর ভেতরের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা ও অপরিষ্কার অবস্থায় পাওয়া যায় বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ। এছাড়া রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে প্রচুর তেলাপোকা পাওয়া গেছে। সেগুলো রেস্টুরেন্টের খাবারের উপর, থালা বাসনে ছোটাছুটি করছিল। রেস্টুরেন্টের প্রতিটি ফ্রিজেও প্রচুর মৃত তেলাপোকা দেখা গেছে।
পাশাপাশি খাবারের উচ্ছিষ্ট হাড় ফ্রিজে যেকোনো উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলেছে, মালিকের কুকুরকে খাওয়ানোর জন্য রাখা হয়েছে। এ সময় কুকরের খাবার কেন মানুষের খাবার মাংসের সঙ্গে রাখা হয়েছে- এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতরা। পরে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করাসহ প্রতিষ্ঠানটিকে পরিবেশ উন্নয়নের জন্য ৩ দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।
খুবই কৌতূহল জাগানিয়া বিষয়টি হল, এই যে জরিমানা খেলো কতগুলো নামী প্রতিষ্ঠান, এঁদের অনেকেই কি না আবার কর্পোরেট। এঁদের রয়েছে নিজস্ব জনসংযোগ ও মিডিয়া বিভাগ। এঁদের কেউ কেউ দন্ড প্রাপ্তির সময় ‘কোথাও ভুল হচ্ছে’ টাইপ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, ঘটনা উত্তর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কোথায়?
নিজেদের নামী-দামী জানান দিতে নানারকম প্রচারণা করেন এঁরা যা দেখে আম জনতা তাঁদের ভোক্তা হন অথচ বিশ্বাসভঙ্গের পর কোন কথাই নেই! নাকি নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ? আসলে এঁদের কাছে ঠকলেও কখনো মুখ বড় করে তা বলার বা বৃহৎ কোন প্লাটফরমে সেটি প্রকাশের সুযোগ কখনোই ছিলো না ভোক্তাকূলের। বড়জোর ওই ফেসবুক পর্যন্তই আম জনতার দৌড়। বলার অপেক্ষা রাখে না, অসহায় ভোক্তাদের কাছে এই অভিযান আসলেই এক পশলা বৃষ্টির মত।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর