চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম—এটা বহুল প্রচলিত তত্বকথা। কিন্তু আমরা রোগ হলে তার চিকিৎসার ব্যাপারে যতটা আন্তরিক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই উদাসীন। এ কারণে সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগের বিস্তার প্রতিনিয়িত বাড়ছে।ফলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়ছে।
Advertisement
অসংক্রামক রোগের ভয়াবহ বিস্তারের কথা এখন আমাদের কারো কাছে আর অজানা নেই। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার এখন ভয়াবহমাত্রায় বাড়ছে। এটা আমরা সাদাচোখেই দেখতে পাচ্ছি। তাই পরিসংখ্যানসূত্র মনে হয় না খুঁজলেও চলে।
যদিও আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু অসংক্রামক নয়; বরং সংক্রামক রোগ তবুও কয়েকদিন আগে বিশ্ব উচ্চ রক্তদিবস পালিত হওয়ায় এটা একটু উল্লেখ করলাম। কারণ স্বাস্থ্য সচেতন হলে এসব রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য মোটেই হুমকি হয়ে উঠতে পারার কথা নয়। তাই এসব রোগ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার অপেক্ষা না করে প্রতিরোধেই মনোযোগী হওয়া দরকার।
ঐ যে বলছিলাম সংক্রামক রোগের কথা। সংক্রামক রোগ মানে হলো যে সকল রোগ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে হাঁচি, কাশি, ছোঁয়া অথবা মলমূত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।এসব রোগের উৎস অনেক সময়ই নানা জীবজন্তু হয়ে থাকে। তারপর সেখান থেকে রোগের জীবাণু মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সংক্রামিত ব্যক্তির দেহ থেকে তা সুস্থ মানুষের দেহে স্থানান্তরিত হয়। আর এমন রোগসমূহ অধিকাংশই হয় প্রাণঘাতী। কারণ ভাইরাস এসব রোগের জীবাণু হিসেবে কাজ করে।
Advertisement
আর আমরা এটাও হয়ত জানি যে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক নামক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ একদমই কাজ করে না। আর এ কারণে এসব রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। তাই সেটাই প্রধানভাবে আমাদের টার্গেট হওয়া উচিত।
(১) আমরা নিপাহ নামক ভাইরাসের কথা আগেই শুনেছি। আমাদের দেশে নানা সময়ে বিভিন্ন প্রান্তে এ রোগে আক্রান্ত রোগীও আমরা পেয়েছি।বাদুড়ের লালা থেকে এ ভাইরাস মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে দেখা যায় সাধারনত শীতকালে খেজুর রসের মৌসুমে গ্রামের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এখন যদিও শীতকাল নয়। তবুও আমাদের সতর্ক হতে হবে। কার এখন ফলের মৌসুম শুরু হয়েছে; বিশেষ করে লিচু। এ ফলটি বাদুড়ের অত্যন্ত প্রিয়।
রাতের বেলা বাদুড়ে খাওয়া লিচু দেখা যায় সকালবেলা গাছের তলায় পড়ে আছে। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাছের নিচে পড়ে থাকা সে ফল বেশ আগ্র্রহ নিয়ে কুড়িয়ে খায়। আধা খাওয়া লিচু থেকে যেহেতু নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে তাই বাচ্চারা যেন এমন ফল না খায় সে ব্যাপারে পরিবারের লোকদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
আর খেয়াল রাখতে হবে এমন ফল খেয়ে করো শরীরে যদি জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা এবং বমি বমি ভাবের উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে দেরী না করে নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে।এবং কুড়িয়ে পাওয়া আধা খাওয়া ফল বিশেষ করে লিচু খেয়ে যদি এ সকল উপসর্গ দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়ে থাকে তাহলে সেটা পরিষ্কারভাবে চিকিৎসককে জানাতে হবে।
Advertisement
এটা একটা দিক। সেইসাথে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভারতে যায়। সেখান থেকেও আমাদের দেশে অনেকে বেড়াতে আসে। এটাও একটা সংক্রমনের উৎস্য হতে পারে।কারণ সম্প্রতি ( ২৩/৫/১৮) কলকাতায় নিপাহ ভাইরাস আক্রাস্ত সন্দেহে বহরমপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া একজন রোগীকে সেখানকার চিকিৎসকেরা বেলেঘাটা সংক্রামক রোগ (আইডি)হাসপাতালে রেফার করেছেন। ফলে আমাদেরকে এসব দিকও ভালভাবে নজরে রাখতে হবে। বিদেশ ফেরত সন্দেহভাজন রোগাক্রান্ত মানুষদের ব্যাপারেও তাই আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। (২)গতবছর চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক সংক্রমণের কথা আমাদের স্মৃতিতে একদম টাটকা থাকারই কথা। এ বছর নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতাও তাই নিত্য সমস্যাই রয়ে গেছে। আর এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয়া এডিস মশা থেকেই যে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ে সেটাও আমাদের অজানা নেই। এ ব্যাপারে তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহকে এখন থেকেই দ্রুত কাজে নেমে পড়তে হবে।
সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাসমূহের প্রথম কাজ হবে আপাতত রাস্তা খোঁড়াখুড়ি বন্ধ রাখা। আর এরই মধ্যে খুঁড়ে রাখা জায়গাগুলোতে কাজ শেষ করে দ্রুত বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া। সেই সাথে জনসচেতনা সৃষ্টি করা। মশারি টাঙিয়ে ঘুমনোর ব্যাপারে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করা।
বাসাবাড়িতে যেন কোনো পাত্রে দীর্ঘদিন ধরে পানি জমে না থাকতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করা। বিশেষ করে ফ্রিজ, এসি এবং ফুলের টবে যেন পানি জমতে না পারে সে ব্যাপারে শতভাগ সতর্ক থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
যেহেতু নিপাহ বা চিকুনগুনিয়ার মতো সংক্রামক রোগ সচেতন হলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব সেহেতু আসুন আগে নিজে সচেতন হই। সেইসাথে পরিবার পরিজন এবং পরিচিতজনদেরকেও সতর্ক করি।আর সরকারী, বেসরকারী এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহ এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করুক-সেটাও কামনা করি।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ,সাভার, ঢাকা।
এইচআর/জেআইএম