জাতীয়

বৃদ্ধাশ্রমেই স্বাধীন আছি

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। লিখতেন জাতীয়, আন্তর্জাতিক জার্নালে। লেখায় এখন আর মন টানে না। বইপড়া আর ইংরেজি দৈনিকে কলাম লেখা ছিল তার স্বভাবজাত নেশা। অথচ জীবনের কোন বেলায় সে নেশা ফিকে হয়ে এলো, তা ঠিক মনে করতে পারেন না এখন। তবে যে নেশায় জীবনের ছবি আঁকেন, তা আজও ভুলতে পারেননি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) মজিবুল হক।

Advertisement

এখন ছবি এঁকেই দিন কাটে মজিবুল হকের। ফ্যাকাসে জীবনের হাজারও গল্প রঙিন করে তোলেন তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে। মন চাইলে মধ্য রাতেও রংতুলি আর আর্ট পেপার নিয়ে বসে যান আশ্রমের নির্জন কক্ষে। ছবির ক্যানভাসে কখন ভোরের আভা ফুটে ওঠে, তা নিজেও টের পান না।

বৃদ্ধাশ্রমের এই বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘ছবিগুলোই এখন আমার বন্ধু। ওরা আমায় দেখে সবসময়। আমায় ছেড়ে চলে যায় না, মানুষের মতো। আমার দুঃখ বোঝে, আমার ভালোবাসা বোঝে। আমার সঙ্গে নিরালায় কথা বলে ওরা। আমি বেঁচে আছি ছবিতে জীবনের গল্প বলে বলে।’

প্রবীণ নিবাসের চতুর্থ তলার বারান্দায় বসেই খানিক আলাপ মজিবুল হকের সঙ্গে। বারান্দার এই জায়গাতে বসেই আকাশ দেখা যায়। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কংক্রিটের শহরের যেটুকু আকাশ দেখা মেলে, তা বড়ই নির্মল। এদিন অবশ্য মেঘের ঘনঘটা। আলাপের মধ্যখানেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও এলো। আর বৃষ্টিভেজা দখিনা হাওয়া গ্রিলের ফাঁক গলে উত্তরে যাচ্ছিল। সে হাওয়া গায়ে লাগছে বলে বৃদ্ধ মজিবুল হক অনেকটাই উদাস এ বেলায়। খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি পরা। পাঞ্জাবি আর প্যান্টে ময়লার পুরো আস্তর। চুল আর দাঁড়িতে সাদারা ভর করেছে আরও বছর দশেক আগে।

Advertisement

আদি নিবাস যশোরে। বাবার জায়গা-জমি ছিল যথেষ্ট। কি কারণে বঞ্চিত হয়েছিলেন সে সম্পদ থেকে, তা অবশ্য বললেন না। পড়ালেখা ঢাকাতেই। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর ঢাকার একটি কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ১৯৮৯ সালে। তবে সে পেশায় থিতু হওয়া হয়নি। ৫ বছর অধ্যাপনা করে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। তবে ভালোবাসা ছিল ছবি আঁকায়। তাতেই আটকে গেল জীবনতরী। সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত। তবে বাড়ি আর থাকা হয়নি। ২০ বছর আগে পরিবার-পরিজন ছেড়ে ঠাঁই নিতে হয়েছে আশ্রমে।

ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাবে খুব সায় দিচ্ছিলেন না। কিসের অভিমানে আশ্রমে আসা, কি কারণ ছিল জীবন থেকে জীবন সরিয়ে নেয়ার, তার আর কিছুই জানা হলো না।

‘কেমন আছেন আশ্রম জীবনের এবেলায়’ এমন কুশল জানতে চাইলে বলেন, ‘বেশ আছি। দিন কেটে যাচ্ছে। ছবি আঁকি। আশ্রমের অন্যদের সঙ্গে গল্প করি। তারাই তো এখন আপন। পত্রিকা পড়ে দিন কাটে।’

সমাজ চিন্তায় বলেন, সব জায়গাতেই তো আগুন জ্বলছে। হিংসা ছাড়া মানুষে আর কি আছে! খুনে উল্লাস করছে রাষ্ট্র নিজেও। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে কেউ নিরাপদ নয়। গোটা দেশটাই কারাগার, বৃদ্ধাশ্রমেই স্বাধীন আছি।’

Advertisement

এএসএস/এমআরএম/জেআইএম