মতামত

আর কিছু শেখাবেন না প্রণবদা

অসুস্থ হওয়ার খবর জানতাম। শরীর কেমন, সেখবরও পাচ্ছিলাম। কিন্তু কখনো চিন্তাও করিনি সকালে নেট খুলেই প্রণবদা’র মৃত্যুর খবর পেতে হবে। মনটা ভারী হয়ে আছে। আমার টেলিভিশনের অ আ ক খ শেখা যাদের কাছে, দাদা তাদের অন্যতম। সাংবাদিকতায় কী করতে পেরেছি জানিনা, কিন্তু এখনো যে টিকে আছি, এবং এতেই যে জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে এর অনেকটা কৃতিত্ব তাঁরই।

Advertisement

সময়টা ২০০৩ এর ডিসেম্বর হবে সম্ভবত। চ্যানেল আই এ যোগ দিলাম। ওই দিন সকালেই বার্তা পরিচালক শাইখ সিরাজ সাহেব, প্রণব দা’র সামনে আধ ফালি চাঁদের মত এক টেবিলে আমাকে নিয়ে বসালেন। বললেন এখানে বস, প্রণব বাবু আসলে তোমার কাজ শুরু হবে।আমি দীর্ঘ সময় একা তাঁর ফাঁকা চেয়ার পাহারা দিালাম। অবশেষে তিনি এলেন দুপুর দু’টোর পর। শান্ত সৌম মূর্তি, গম্ভীর। দেখতে ভয় লাগে।

জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি পলাশ? বলতে বলতে বসলেন। তার পর আর কোন কথা নেই, ছয়/সাতটি স্ক্রিপ্ট এবং ভিএইচএস ক্যাসেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন এগুলো রিডার্স বানান। আজকের দিনে আমরা যেটাকে উভ বা ভিও বলি, চ্যানেল আই তখন সেটাকে রিডার্স বলতো। সেটাও আমি জেনেছি অনেক পর।

শুধু কী রিডার্স? আমি আগে টেলিভিশনে কাজ করেছি কী না? ক্যসেটের ছবি কী ভাবে টেলিভিশনে প্রচার হয়? টেলিভিশনের পাণ্ডুলিপি লিখেছি কী না? এসব কোন প্রশ্নের ধার কাছ দিয়ে গেলেন না। আমি এর ওর কাছ থেকে ধারণা নিয়ে ঘণ্টা দু’য়েকের ধস্তাধস্তিতে রিডার্স নামের সেই বস্তু লিখলাম। এটা দিয়ে কী হবে তাও জানি না। তার সামনে নিয়ে ধরলাম। তিনি খুব বিরক্ত হলেন, নানা ভাবে সেই বিরক্তি প্রকাশ করে আমার লেখা কাটাকুটি করলেন। বললেন আজ যেটা কাটলাম আগামী দিন সেটা কাটতে গেলেই বকা খাবেন।

Advertisement

সেই শুরু। তারপর টানা চার বছর মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁকে অনুসরণ করেছি। দেখে দেখেই শিখেছি। যখন যা বলতেন মনে রেখেছি। আর বকা খেতে হয়নি বরং তিনি অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। কাজের বাইরে চলা বলার নানা পরামর্শ পেয়েছি তার কাছে। সব শেষ দেখা হয়েছিল অফিসার্স ক্লাবের এক মেলায়। তখনো সুস্থ ছিলেন। সব খোঁজ খবর নিলেন, মজা করলেন সেই আগের মতই।

টেলিভিশনে কাজ করার ১৬ বছর হলো। অনেকের সঙ্গেই কাজ করলাম। এখনো করছি এবং শিখছি .. কিন্তু সেই যে প্রথম শেখা তার গুরুত্ব আমার কাছে সবচেয়ে বেশি। তাই শিক্ষক হিসেবে তার গুরুত্বও আমার কাছে সর্বোচ্চ। তার চেয়ে বড় কথা, তার সঙ্গে থাকার মানেই কিছু না কিছু শেখা, প্রতিটা শব্দে শব্দে শেখা। কাজ করতে করতে তিনি শুধু ওই দিনের জন্যে শেখালেন তা নয়। কথা বলতেন আজীবনের জন্যে। আর এমন ভাবে বলতেন যেন কখনো না ভুলি।

প্রণবদা’র নিউজরুমে বলা কথা এখনো কানে বাজে “সলিল সমাধি” বলে কিছু হয় না, পাট ক্ষেত নুয়ে পড়ে না, নুয়ে পড়ে ক্ষেতের পাট। মারা যাওয়া যায় না, আসলে মৃত্যু হয়। ফলজ বলে কিছু নেই। হয় শুধু না হয় মাত্র। এরকম আরো কত কী .. এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না।

প্রণবদাদার অসুস্থ হওয়ার কথা শুনেছি অনেক দিন হলো। কিন্তু যাব যাব করেও একদিনও দেখতে যেতে পারিনি। যাওয়া হয়নি আসলে। এই দায় একান্তই নিজের। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আসলে শিখলাম, এই ইট কাঠ পাথরের এই যান্ত্রিক শহরে আমি এবং আমার মত অনেকেই নেহায়েত জীবনটাই যাপন করছি। এখানে মানবিকতা খুবই অর্থহীন শব্দ।

Advertisement

লেখক : বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন।

palash_ahasan2003@yahoo.com

এইচআর/পিআর