১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নয়, তার পেছনে রয়েছে ঘটনাবহুল ইতিহাস। তেমনি একটি ইতিহাসের ঘটনা হল ১৯৬৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি। ঐ বছর ৭ জুন দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয় দাবির পক্ষে। তাই এই দিনটি ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাঙালির কাছে।
Advertisement
ঐদিন আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গি, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআর’র গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ ১০ জন বাঙালি শহীদ হন। পরাধীন বাঙালি জাতি এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আপোসহীন সংগ্রামের ধারায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যায়। ৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল- প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সকল ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দু’টি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপনের দাবি জানানো হয়।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬। সেদিন লাহোরে তাসখন্দ চুক্তিকে কেদ্র করে অনুষ্ঠিত সাবজেক্ট কমিতিতে বাঙালির মুক্তির সনদখ্যাত ৬ দফা উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি সম্মেলনে পরের দিনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এই ৬ দফা স্থান পায় সে ব্যাপারে সম্মেলনের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। কিন্তু আয়োজকরা দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সে সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ৬ দফা উত্থাপন করেন।
যার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে আখ্যায়িত করে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে হুমকি ছেড়ে বলেন, ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে। তারপর ঢাকায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ৬ দফা পাস করিয়ে নেন। ঐ বছরের ১৮ মার্চ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ৬ দফা গৃহীত হয়। ৬ দফার পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা’ শিরোনামে একটি বই সবার কাছে বিতরণ করা হয়।
Advertisement
বইতে ৬ দফা দাবি তুলে ধরার প্রারম্ভে এ প্রসঙ্গে কিছু কথা টেনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে একটি জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই।
খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি- তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬ দফা দাবি অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬ দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে।’
ঐতিহাসিক ৬ দফার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়। মূলত ৬ দফার মূল বক্তব্য আমাদের এই বার্তাই দেয় যে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন শোষণের হাত থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনভাবে নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় সেই মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আমরা একাত্তরে শত্রু নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই দেশ স্বাধীন করেছিলাম। তাই ৬ দফা দাবি এবং সেই দিবসটি আমাদের কাছে ঐতিহাসিকভাবে চিহ্নিত।
লেখক : কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।
Advertisement
এইচআর/আরআইপি