মতামত

বাজেট : বাঙালি বুঝ, মার্কিনি জোকস

 

বাজেটের নানা টার্ম ও অংক সরাসরি বুঝতে অভ্যস্ত নয় সাধারণ মানুষ। একদিকে ঘাটতি, সংকট, ফাঁকিবাজি, চাতুরি, ধোকাবাজি, অন্যদিকে সেরা, জনবান্ধব, জনমুখী ধরনের শব্দমালায় তাদের সামনে ফিবছর হাজির হয় জাতীয় বাজেট।

Advertisement

এসব শব্দের মাজেজা যে দল যেভাবে পারে মানুষকে বোঝায়। এসব বাহাসের ফাঁকে বাজেট বলতে আমজনতা নিজের একটা বুঝে স্থির হয়। তাই তাদের কাছে বাজেটের আরেক নাম নিত্যপণ্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ানোর বার্ষিক উৎসব। বাজেটের আগে পণ্যের দাম একবার বাড়ে। ঘোষণার পর বাড়ে আরেকবার। আর বাজেট কার্যকরের পর দামবৃদ্ধি তো একেবারে আনুষ্ঠানিক। বাজেটের ছুতায় কমছে কম তিনবার জিনিসপত্রের এ দাম বাড়ানোর কালচারে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে গেছে। নিয়তির মতো তারা তা হজমও করে। এরপরও বাজেটে কিসের দাম কমবে সেটা জানার অপেক্ষা তাদের একটু বেশি। শেষ পর্যন্ত মূল্যহ্রাসের ঘটনা বড় মামুলি।

জাতীয় বাজেট না বুঝলেও ঘরের বাজেট বোঝে সবাই। নিজের ঘরবসতিতে সবাই যার যার ওজন মতো বাজেট করে। তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করে। তবে, পারিবারিক বাজেট আর রাষ্ট্রের বাজেটের মধ্যে রকমফের রয়েছে। গুণগত তফাৎও বিস্তর। অংক বা সাইজের ফারাক তো বলার অপেক্ষায়ই রাখে না। রাষ্ট্রের বাজেটে বহুপক্ষের ভাগ থাকে। পারিবারিক বাজেটে তা নেই।

এছাড়া, পারিবারিক বাজেটে সম্ভাব্য ব্যয় হিসাব করা হয় আয় দৃষ্টে। রাষ্ট্রীয় বাজেটে তা একেবারে উল্টো। রাষ্ট্রীয় বাজেটে আগে ধরা হয় খরচের হিসাব। পরে তৈরি করা হয় আয়ের টার্গেট। বছরের শুরু থেকেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তদের পরবর্তী বছরের খরচ আর চাহিদা অর্থমন্ত্রণালয়কে জানানো শুরু করে। এ জানাজানির কাজ শেষ হয়ে যায় ফেব্রুয়ারির মধ্যে। তাদের চাহিদার মধ্যে বেতন ভাতার বাইরে থাকে- দামি গাড়ি কেনা, বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ সুবিধা, বিদেশে ভ্রমণের চাহিদা ইত্যাদি। এর বাইরে থাকে উন্নয়ন খাতের চাহিদা।

Advertisement

গেল বারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অসমাপ্ত কাজের সাথে চলতি বছরের কিছু কাজ, কিছু প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পের কাজ, আর মেগা প্রকল্পগুলোর বিল পরিশোধের তাগিদও দেয় মন্ত্রণালয়গুলো। যা মোট বাজেটের ৩৬ %-এর কম নয়। এটার নামই উন্নয়ন বাজেট। বাকিটা রাজস্ব। উন্নয়ন বাজেটের চুরি-চামারি, দুর্নীতি, অপচয় বাদ দিলে প্রকৃত উন্নয়ন কত পার্সেন্ট দাঁড়ায়? বাজেট সংশ্লিষ্টরা তা জেনে-বুঝেও সেইপথে যান না।

অবুঝ সাজেন। ব্যাপারটা জানেন না, বা এই বুঝি শুনলেন এমন ভাব দেখান। ভাবের সঙ্গে ভঙ্গিও করেন। বাজেট ঘোষণার পর বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে প্রশ্নবান শুরু হলে তারা আসমান থেকে পড়ার ভান করেন। বিষয়টার একটা হিল্লা করার আশ্বাস দেন। বছর বছর চলে আসছে এভাবেই। ততক্ষণে কর-রাজস্ব আদায়ের জন্য জনসাধারনের উপর ষ্টীম রোলারটা এগিয়ে যায় অনেক পথ।

শোনা যাচ্ছে এবার প্রায় এক লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত কর আদায়ের টার্গেট করে বাজেট বানানো হচ্ছে। এমনিতেই দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের দশা সই অবস্থা। তার উপরে ব্যাংক ও শেয়ার বাজারের করুণ হাল। অর্থনীতির এ ভঙ্গুর হাল-দশা থেকে নিস্তার পেতে অনেকে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পরামর্শ দিচ্ছেন। যেমনটি মালয়েশিয়ায় শুরু করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। নতুন দফায় ক্ষমতায় এসে কৃচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে তিনি মন্ত্রী আর আমলাদের বেতন ১০% কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দৃশ্যপট ভিন্ন। কৃচ্ছ্রতার বিপরীতে আমরা খরচের পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়ে চলেছি। বাংলাদেশে মন্ত্রী- সচিবদের ৭৫ হাজার টাকার মোবাইল ও আনলিমিটেড বিল। একই সময়ে মাহাথিরের মন্ত্রীদের বেতন ১০% কমানোর ঘোষণা। দেশে অর্থনৈতিক সাশ্রয় আনতে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীদের এ বেতন কমানো হচ্ছে। ১৯৮১-তে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি এ ধরনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এর প্রথমেই ছিল ছিল মন্ত্রী ও সরকারের । ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন। এর বিশাল সুফল পেয়েছে মালয়েশিয়া। অথচ বাংলাদেশ?

আমাদের মধ্যে মালয়েশিয়া হবার ঢেঁকুর ওঠে। অমুক-তমুককে মাহাথিরের সঙ্গে তুলনার বাতিকও কম নয়। কিন্তু চর্চার দশা গুরুচরণ। আমাদের আমলারা সরকারের কাছ থেকে প্লট, ফ্লাট, গাড়ি, মোবাইল ফোন, ফোনের বিল, ড্রাইভার, বাবুর্চি সব নিয়েও তুষ্ট নয়। কেবল বৌয়ের ভয়ে নতুন করে বিয়ের খরচ চাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।

Advertisement

মাত্র কদিন আগে শুল্ক মুক্ত গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, শেষ করে তারা সরকারি টাকায় স্মার্ট ফোন হাতানোর ইজাজতও পেয়েছেন। স্মার্ট ফোন কেনার টাকার পর দেয়া হবে বিলটাও। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের মোবাইল ফোন কিনতে ৭৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। তা ব্যবহার করা যাবে আনলিমিটেড। তারা যতো খুশি কথা বলবেন। পুরো বিলটা শোধ করবে সরকার।

এরইমধ্যে বিজনেস কমিউনিটি থেকে আবদার এসেছে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এ বছর নতুন করে করের টার্গেট না বাড়ানোর। কর না বাড়িয়েও রাষ্ট্রীয় ব্যয় মেটাতে সমস্যা হবে না বলে খাতওয়ারি অংক কষে দেখিয়ে দিয়েছেন তারা। এর মাঝে আবার উল্টো ক্রিয়া-কর্মও রয়েছে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিম্মতঅলা উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ সরকারের কাছ থেকে বাড়তি ন্যায্য ও অন্যায্য সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নেন। এর কিছু আয়ত্ব করেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তয়তদ্বীর করে। বাকিটা নেন অর্থ ও পুঁজিবাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি জন্ম দিয়ে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, আসন্ন বাজেটেও আরো কিছু প্রাপ্তির আসায় উভয় বাজারে সংকট ধরে রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর প্রকাশ্য বিবৃতি ও আশ্বাসেও কাজ হচ্ছে না। আবার সরকারও সরিষার ভেতরের এসব ভূত জ্যান্ত রাখছে। মাঝেমধ্যে তাড়ানোর আওয়াজ দিয়ে আবার ব্যাকগেয়ারে যায়।

এর মাঝেই এগিয়ে আসছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। মানবসম্পদ উন্নয়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে চার লাখ আটষট্টি হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এটি হবে প্রাথমিক প্রাক্কলন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবারের বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) রেকর্ড সংখ্যক নতুন প্রকল্পের আভাসও দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচনী বছর হওয়ায় রাজস্ব সংগ্রহে সরকারের দিক থেকে নতুন নতুন পথ খোঁজা হবে না। ফলে রাজস্ব সংগ্রহ স্বাভাবিকভাবে যা বাড়বে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে সরকার। ২০১৮-১৯ সালে দেশের মোট জিডিপি হবে ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে তা ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ধরা হতে পারে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৪ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।

আর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ধরা হতে পারে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এর বাইরে এনবিআর ও করবহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হতে পারে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর সার্বিকভাবে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। যা বর্তমানে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। বিশাল পরিমাণ এই ঘাটতি পূরণ করা হবে বৈদেশিক ঋণ, অনুদান, স্থানীয় ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে।

আগামী বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর আভাসও দেয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এ খাতে তেমন ভর্তুকি রাখতে হয়নি, সরকারও স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় সম্পদ কমিটির বৈঠকে জ্বালানি খাতে বড় আকারের ভর্তুকি রাখার পরামর্শ এসেছে।

এ ছাড়া আগামী ১ জুলাই থেকে সরকারী কর্মচারীদের জন্য গৃহনির্মাণ ঋণ দিতেও ভর্তুকি রাখতে হবে। গৃহনির্মাণ খাতে জনগণকে ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হলেও সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে নেয়া হবে ৫ শতাংশ। বাকি টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী বসতি গড়ে দেওয়া হবে।

এ জন্য বাজেটে এ খাতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হবে। বাংলাদেশে আশ্রিত নতুন-পুরনো মিলিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ। বিপুলসংখ্যক এই রিফিউজির বসবাসের জন্য ভাসানচর যথেষ্ট নয়। ফলে কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালংসহ অন্যান্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও নতুন বরাদ্দ দিতে হবে।

এসব অংক ও ব্যয়-বরাদ্দের আগপিছ সবার মুণ্ডুতে কুলাবে না। তা ভালো বোঝেন শুধু এক্সপার্টরা। তাদের বিশেষজ্ঞ মতামত ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অনেক কিছু আসবে-যাবে। সাধারণ মানুষের কোনো কথায় কিছু যায়-আসে না। যাবে আসবে বাজেট ঘোষক অর্থমন্ত্রীর কথায়। এ প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের বাজেট বিষয়ক একটা মন্তব্য স্মরণ করা যায়। বাজেটের কাগজপত্র হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ এটা নিশ্চয়ই একটা আস্ত বাজেট। কারণ এতে অনেক সংখ্যা দেখা যাচ্ছে। সুদূর মার্কিন মুল্লুকে বাজেট আলোচনায় এটি এখনো জোকস হিসেবে বেশ জম্পেশ। আর আমরা তো মামুলি বাঙাল।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএস