মতামত

নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ‘পাকিস্তান মডেল’

পাকিস্তানের ৭১ বছরের ইতিহাসে সেনা শাসন ছিল ৩১ বছর আর বাকি সময়টা সেখানে সেনা সমর্থিত বা সেনা বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করা সরকার ক্ষমতায় ছিল- একথা আমার নয়, এই তথ্য পাকিস্তান সম্পর্কিত গবেষকদের, যার মধ্যে পাকিস্তানের জনপ্রিয় পত্রিকা দ্য ডন-এর এক সময়কার সম্পাদক আব্বাস নাসিরও রয়েছেন।

Advertisement

মজার ব্যাপার হলো এই ৭১ বছরের ইতিহাসে মাত্র একবার পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছিল এবং তারপর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারাও পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে, সম্প্রতি দেশটিতে দ্বিতীয়বারের মতো শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর’ নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, অনেকেই মনে করছেন যে, এই তথাকথিত ‘শান্তি’ আসলে ভয়- ভয় ক্ষমতা হারানোর, ভয় ক্ষমতা দখল হয়ে যাওয়ার, ভয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার, ভয় জেলে যাওয়ার এবং দেশের রাজনীতিকে পুরোপুরি কব্জায় নিয়ে আসার। তাই রাজনীতিবিদরা এই ভয় থেকে মুক্তির জন্যই আপাতঃভাবে এই ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরকে’ মেনে নিয়েছে। যদিও ইতোমধ্যে তারা যা হারিয়েছেন তা কিছু কম নয়। সে কথায় পরে আসছি, তার আগে দেখে নিতে চাই পাকিস্তানের রাজনীতির বর্তমান চিত্রটি।

আমরা একথা জানি যে, পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত কিন্তু তিনি সাজা ভোগ করছেন না বরং দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি শুধু সাজাপ্রাপ্ত তাই-ই নন, তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে অযোগ্য একজন ব্যক্তি। সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সে দেশে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিচার হয়েছে এবং আদালতকেও নির্দেশনা দিয়েছে সে দেশের সেনা বাহিনী। সংসদীয় নেতা কে হবেন সে প্রশ্নের উত্তর যেমন সেনা বাহিনী ঠিক করে দিচ্ছে তেমনই প্রধানমন্ত্রী কাকে করা হবে সেটিও ঠিক করে দিচ্ছে সেনা বাহিনীই।

এখন সরকারের মেয়াদ শেষে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে একজন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাকেও সেনা বাহিনীই ঠিক করে দিয়েছে বলে পাকিস্তানেই কথা শোনা যাচ্ছে। আর সে জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এবং সম্মিলিত বিরোধী দলকে, যাতে তারা একজন অন্তর্বতীকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে একমত হয় এবং আগামী ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে (পড়ুন সেনা বাহিনীর ইচ্ছানুযায়ী) সম্পন্ন করতে পারে।

Advertisement

আগেই বলেছি পাকিস্তানের মোট বয়সের ৩১ বছরই সেনা শাসনের অধীনে ছিল এবং বাকি বছরগুলিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র, নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সবই সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। আবার নির্বাচনে সেনা বাহিনীর পছন্দের রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় এনে তাদেরকে দিয়ে সেনা বাহিনীর পক্ষে কাজ করানোর খবরও আমরা জানি। আর পাকিস্তানের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটিও বরাবরই করেছে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী।

দেশটির ভয়ংকর জঙ্গীবাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী এবং সেখানে তাদের শক্তিশালী ‘নিবাস’ তৈরিতে সহায়তা দিয়েছে। তাদেরকে দিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন থেকে শুরু করে দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টি করে সরকারকে চাপে রাখা, আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সঙ্গে অর্থনৈতিক দর কষাকষি করে পাকিস্তানকে এক প্রকার ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে’ই পরিণত করেছে। মজার ও দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, আজকেও পাকিস্তানে ‘গণতেন্ত্রর’ পাহারাদার হিসেবে সেনা বাহিনীই ভূমিকা নিয়েছে।

নওয়াজ শরীফের প্রতি পাকিস্তান সেনা বাহিনীর নারাজ হওয়ার কারণ ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরীফ সরকারের ওপর থেকে সেনা বাহিনীর আধিপত্য কমানোর চেষ্টা করছিলেন। বিশেষ করে পৃথিবীময় যখন পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে তখন সেনা বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গীগোষ্ঠীর যোগসাজশ থেকে রাষ্ট্রটিকে মুক্ত করতে নওয়াজ শরীফ পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছিলেন। তাই বলে নওয়াজ শরীফ দুর্নীতি করেননি সে কথা বলছে না কিন্তু তাকে যে প্রক্রিয়ায় সরানো হয়েছে ও রাজনীতি থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছে তাও যে গণতান্ত্রিক নয় সেটাই আলোচ্য বিষয়।

কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের এই ভূমিকাকেও গৌরবের চোখে দেখা হয় এবং সেনা বাহিনীর নির্দেশে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে শাস্তি দেওয়া এবং তাকে রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করানো কখনওই গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না সে প্রশ্ন বাংলাদেশে তোলা যাবে না। কিন্তু তারা আবার এদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির দায়ে আদালতের নির্দেশে সাজা দেওয়াটা মেনে নিতে পারেন না। বড়ই সঙ্কটের ব্যাপার বটে!!

Advertisement

ফিরে আসি পাকিস্তানের নির্বাচনের প্রশ্নে। ২৫ জুলাই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রয়টার্স জানাচ্ছে যে, এরই মধ্যে পাকিস্তানের সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে সদ্য বিদায় মুসলিম লীগ তথা নওয়াজ সমর্থকদের বহুবিধ হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে না এবং সেনা বাহিনী যে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনতে চাইছে সেটাও দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আন্তর্জাতিক জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বলছে যে, এখনও দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ চায় নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগকে, দ্বিতীয় অবস্থানে প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি থাকলেও দলটিকে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী ‘কোমর ভেঙে দিয়েছে’ বলে পাকিস্তানি সাংবাদিক বন্ধুরাই সব সময় বলে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানে এবার কিংস-পার্টি হিসেবে জনপ্রিয়তা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সাবেক ক্রিকেটার বর্তমানে রাজনীতিবিদ ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফকে।

ধারণা করা হচ্ছে যে, আসন্ন নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে যাচ্ছে নওয়াজের মুসলিম লীগ ও ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এর মধ্যে। ইতোমধ্যেই ইমরান খান নির্বাচনী প্রচারণায় নওয়াজের দুর্নীতির কার্ডটি খেলতে শুরু করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রচারনায় নওয়াজের মুসলিম লীগ একথা একবারও মুখে আনতে পারছে না যে, ইমরান খান একজন আপাদমস্তক ‘লম্পট’ রাজনীতিবিদ। এটা এ কারণেও হতে পারে যে, পাকিস্তানে আসলে বহুবিবাহ বৈধ এবং পুরুষের ‘লাম্পট্য’কে সমাজ একরকম মেনেই নিয়েছে।

ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের গণমাধ্যম নির্বাচন নিয়ে এক ‘সঙ্কটকাল’ পার করছে বলে রয়টার্সও মনে করছে। জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল জিও টিভি-র সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, গত এপ্রিলে আবার চ্যানেলটি কার্যক্রম শুরু করলেও বলা হচ্ছে যে, চ্যানেলটি আসলে এই মুচলেকা দিয়েই সম্প্রচারের অনুমতি পেয়েছে যে, তারা কোনো ভাবেই নওয়াজ শরীফের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের পক্ষে যায় এমন কোনো সংবাদ প্রচার করবে না।

দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন সেনা বাহিনী নিয়ন্ত্রিক ক্যান্টনমেন্টগুলোতে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না এবং দেশের ভেতরেও এর প্রদায়কদের পত্রিকাটি বিক্রি বন্ধ করতে চাপ দেওয়া হয়েছে। দেশের বিখ্যাত কলাম লেখকরা একযোগে বিবৃতি দিয়ে তাদের লেখাকে ‘সেন্সরড’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। রয়টার্স আমাদের এও জানাচ্ছে যে, পাকিস্তানের নির্বাচনে অতীতেও এরকম প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে কিন্তু এবার তার মাত্রা ‘সবদিক’ থেকেই অতিক্রম করে গেছে।

সেনা সমর্থিক কিংস-পার্টিগুলির ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটে থাকে, এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে দলে দলে গিয়ে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। বলা হচ্ছে যে, বেশিরভাগই আসলে সেনা বাহিনীর চাপের কারণেই দলত্যাগী হচ্ছে। তবে এটা বেশিরভাগই হচ্ছে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগের নেতাদের ক্ষেত্রে, তারা এই চাপ সহ্য করতে পারছেন না বলেই বিদেশি গণমাধ্যমকে নিজেদের নাম গোপন রেখে জানাচ্ছেন। যদিও ইমরান খান এসব অভিযোগ নাকচ করে দিচ্ছেন। তার লক্ষ্য পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত পাঞ্জাব রাজ্য, জাতীয় পরিষদের ২৭২ টি আসনের মধ্যে ১৪১টিই এই পাঞ্জাব রাজ্য থেকে। ফলে অভিযোগকে কেউ অস্বীকারও করতে পারছেন না।

কিন্তু মজার বিষয়তো এখনও বলাই হলো না। পাকিস্তানে সম্প্রতি নির্বাচনী আইনে সংস্কার এনে এটা যুক্ত করা হয়েছে যে, কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনী প্রচারণায় তাদের “অর্জন” সম্পর্কে কথা বলতে পারবে না। ক্ষমতায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল যদি জনগণের জন্য কোনো কাজ করে থাকে নির্বাচনী প্রচারণায় তা ব্যবহারের রীতি সর্বত্র স্বীকৃত। কিন্তু পাকিস্তানে এটা করা যাবে না কারণ তাতে নাকি ভোটাররা ‘প্রভাবিত’ হতে পারে।

সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া নওয়াজ শরীফের রাজনৈতিক দল বলছে, তাহলে আমরা বলবো কি জনগণের কাছে? চীনের সঙ্গে মিলে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরটাই যদি দলটি নির্বাচনে ব্যবহার করতে না পারে তাহলে তাদের হাতে বাকি থাকছে কেবল নওয়াজ শরীফের দুর্নীতি সম্পর্কে কথা বলা, কিন্তু সেই শাস্তি সম্পর্কেও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারবে না।

এই হচ্ছে পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নমুনা, অথচ চাপের মুখে একজন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে মাতম উঠেছে, পাকিস্তানেও গণতন্ত্র আছে, আর বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই বলে। কে জানে বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের পাকিস্তানী মডেল বাস্তবায়নে কেউ দুঃস্বপ্ন দেখছে কিনা!!

ঢাকা ৫ জুন, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/আরআইপি