ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রোগীদের জরুরি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে রাখা হয়েছে একাধিক লিফট। এসব লিফট পরিচালনার জন্য প্রতিটিতে রাখা হয়েছে একাধিক অপারেটর বা লিফটম্যান। কিন্তু তারা এ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন না। অভিযোগ রয়েছে, বাড়তি আয়ের আশায় বেশিরভাগ সময় তারা হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় হিসেবে এবং স্ট্রেচারসহ অন্যান্য কাজে জড়িত থাকেন তারা।
Advertisement
এদিকে লিফটম্যান না থাকায় ব্যবহারকারীরা পড়েন চরম বিড়ম্বনায়। ফলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে চাপা ক্ষোভ।
অন্যদিকে হাসপাতালের কয়েকটি লিফট বহুবছরের পুরনো এবং সংস্কার না করায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকায় এখনও সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এসব লিফট ব্যবহার করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজন এবং নার্স ও চিকিৎসকরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, এসব সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে, তবুও নেয়া হচ্ছে না সমাধানের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। এ কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত এবং সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাদের দাবি, এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
Advertisement
ঢামেক হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসক, নার্স, রোগী, তাদের স্বজন ও শিক্ষার্থীসহ প্রায় কয়েক হাজার মানুষের পদচারণা ঘটে। তাদের নির্বিঘ্নে চলাচলে প্রতিটি ফ্লোরের জন্য রয়েছে একাধিক সিঁড়ি। পাশাপাশি রোগী ও সিঁড়ি দিয়ে চলাচলে অক্ষম এবং দ্রুত রোগীর সেবায় নার্স ও চিকিৎসকদের জন্য রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ চালিত লিফট।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ঢামেকে তিনটি লিফট স্থাপন করা হয়। এরপর যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপন হয়েছে আরও নতুন ও অত্যাধুনিক লিফট। কিন্তু আধুনিক লিফট স্থাপন করা হলেও পুরনোগুলো এখনও সংস্কার করা হয়নি। বর্তমানে নতুন-পুরান মিলে হাসপাতালের মূল ভবন ও বার্ন ইউনিটে মোট ১০টি লিফট রয়েছে। এগুলোর পরিচালনায় আছেন ১৫ জন অপারেটর।
তার মধ্যে- বার্ন ইউনিটে ২টি লিফটে কাজ করছেন ২ জন লিফটম্যান, ওটি বা আইসিইউ ভবনে ৩টি লিফটের জন্য আছেন ৪ জন, কেবিন ব্লকে ২টি লিফটের জন্য আছেন ৪ জন, ইউরোলজি ভবনে ১টির জন্য ১ জন, আইব্যাংক ভবনে ১টির জন্য ২ জন এবং বহির্বিভাগের ১টির জন্য আছেন ২ জন।
এছাড়া নতুন ভবনে রয়েছে আধুনিক সাতটি লিফট। এরমধ্যে কেবিন ব্লকের ১টি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আর আইসিউ, ও বহির্বিভাগের মোট ২টি লিফটও ব্যবহারের অনুপযোগী পড়েছে।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা যায়, এসব লিফটে দীর্ঘক্ষণ চলাচল করেও দায়িত্বশীল কোনো অপারেটরকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রতিটি লিফটই ব্যবহার করছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। এ সময় লিফটম্যান না থাকায় ব্যবহারকারীরা একে অপরের সহযোগিতায় লিফট পরিচালনা করে নির্ধারিত ফ্লোরে পৌঁছাচ্ছেন। রোগী নিয়ে স্বজনদেরকে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। অথচ প্রতিটি লিফটের জন্য রাখা হয়েছে কমপক্ষে একজন করে অপারেটর।
এদিকে বহির্বিভাগের লিফটির নেই কোনো দরজা। নেই কোনো সুইচ নির্দেশক। লোহার কলাপসিবল গেট দিয়ে সেটি আবদ্ধ থাকে। ফলে যে কোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। কিন্তু এমন লিফটেও খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো অপারেটর।
এছাড়া বার্ন ইউনিটের রোগীদের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত লিফটের সেন্সর বহুদিন ধরে নষ্ট। এটিও লিফটম্যান ছাড়া ব্যবহার প্রায় অসম্ভব। তবুও চলছে লিফটম্যান ছাড়াই। কিন্তু মাস শেষে ওই লিফটের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত বেতন নিচ্ছে একজন অপানেরটর। ওই লিফটির দরজা খোলার পর মানুষ প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার আগেই দরজা লেগে যায়। এজন্য দরজা খুলে রাখতে সুইচ চাপ দিয়ে ধরে রাখতে হয়। সেন্সর অকেজো অবস্থায় বহুদিন ধরে চলছে লিফটি। এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। নিয়ম অনুযায়ী লিফটের কোনো ত্রুটি দেখা দিলে সেটি লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করলেই তারা সমাধান করে দেয়। কিন্তু এ লিফটের সমস্যার ব্যাপারে কিছুই জানেন না এটির পরিচালনা প্রতিষ্ঠান মান বাংলাদেশের ম্যানেজার। অথচ ঢামেকে দায়িত্বরত গণপূর্ত বিভাগের (পিডব্লিউডি) সহকারী প্রকৌশলী বলছেন বিষয়টি তাদেরকে অবহিত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বৃস্পতিবার অপারেশনের রোগী নিয়ে আইসিইউ ভবনের লিফটে করে যাওয়ার সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে আটকা পড়েন পোস্ট অপারেটিভ বিভাগের অফিস সহকারী মো. মামুন। এ সময় তিনি দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো লিফটম্যানকে খুঁজে পাননি। লিফটের ভেতর থেকে অনেক্ষণ দরজা ধাক্কা দেয়ার পর নিচে অবস্থানরত লোকজন তাকে খুঁজে আনে, রোগীকে নিয়ে বের হয় মামুন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অফিস সহকারী বলেন, তারা কেউ লিফটে থাকে না। এটা একেবারেই সত্য। ব্যবহারকারীরা নিজেরাই লিফট চালিয়ে ওঠানামা করেন। অথচ এসব লিফটের অপারেটররা নিজেদের কাজ না করে জরুরি বিভাগে গিয়ে ট্রলি টানেন, ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করেন। কেউ কেউ আবার নতুন ভবনের গেটের পাশে পান-সিগারেটের দোকান খুঁলেছেন। পুরো মাস এসব কাজ করে আবার মাস শেষে হলে লিফটের বেতন নেন। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই।
এসব অভিযোগ স্বীকার করে আইসিইউর রায়হান নামে একজন লিফট অপারেটর জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে আমরা বাইরেও কাজ করি। কিন্তু তা সব সময় করি না। যখন হাতে টাকা-পয়সা থাকে না, বিশেষ করে মাসের শেষের দিকে আমরা এমন কাজ করি। কারণ আমাদেরকে যে বেতন দেয়া হয় তাতে ঢাকার শহরে চলা দায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে মাসে বেতন দেয় ছয় হাজার টাকা। কিন্তু এ টাকা দিয়ে কি চলা যায়? লিফট চালু অবস্থায় অপারেটরকে ভিতরে থাকতে হয় কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নিয়মানুযায়ী তো অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু বাড়তি কিছু ইনকামের জন্য আমরা অনেক সময় থাকি না। বেতনটা একটু বাড়ালে কেউ অন্য কাজ করবে না।’
লিফটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা ও ত্রুটির বিষয়ে মান বাংলাদেশের ম্যানেজার মো. মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, লিফটম্যান ঠিকমত দায়িত্বপালন করে না এমন অভিযোগ আমরা এখনও পাইনি। বার্ন ইউনিটে লিফটের সেন্সর কাজ করছে না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ এ রকম কিছু আমাদের বলেনি। এমন তথ্য পেলে আমরা তা দ্রুত মেরামত করি।’
একই কথা বলেছেন, অন্য একটি প্রতিষ্ঠান রশিদ এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার বজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। লিফটম্যানদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়ে তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে জানাবেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
ঢামেকে দায়িত্বরত পিডব্লিউডির সহকারী প্রকোশলী মো. মিজানুর রহমান প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকটা লিফট অনেক পুরনো হওয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। এ বিষয়ে পিডব্লিউডিতে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
এসএইচ/এমএমজেড/এমএস