জাতীয়

বৃদ্ধাশ্রমে ইফতার আসে, সন্তানেরা আসে না

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বৃদ্ধাশ্রমে (প্রবীণ নিবাসে) রোজ ইফতার সামগ্রী আসে। মুখ রোচক বাহারি পদের ইফতার সামগ্রীতে ভরে যায় আশ্রমের বারান্দা। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে নিয়ে আসেন, আবার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও পাঠানো হয় ইফতার। কিন্তু দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা সন্তানেরা আসে না।

Advertisement

আশ্রমের প্রবীণদের জন্য সোমবারও চলছে ইফতারের আয়োজন। পিডব্লিউডি-এর এক প্রকৌশলীর সৌজন্যে এ আয়োজন। সম্প্রতি ওই প্রকৌশলীর মা ইন্তেকাল করেছেন বলে জানালেন নিবাসের কর্মচারীরা। মাকে হারানোর বেদনা থেকেই বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় এই বাবা-মায়েদের সঙ্গে বসে সময় কাটানোর জন্য আয়োজন করেছেন তিনি।

তবে অন্যের পাঠানো ইফতার নিয়ে অভিমানও করেন কেউ কেউ। অনেকে ছুঁয়েও দেখেন না। সে অভিমান অবশ্য ইফতারের সঙ্গে না। হয়তো নিজের প্রতি নতুবা নিজ সন্তানের ওপর অভিমান করেই ইফতার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন। এ কারণে গত বছর অন্যের পাঠানো ইফতার দেয়া বন্ধ ছিল এ আশ্রমে। এবার অবশ্য নিতে রাজি হয়েছেন তারা। রোজার শুরু থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন হচ্ছে এখানে।

১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ এই নিবাসে বর্তমানে ৫০ প্রবীণের থাকার সুযোগ মিলছে। ৫ হাজার টাকা রুম ভাড়া আর ২৮শ’ টাকা খাবার বাবদ ব্যয় করতে হয় তাদের। এখানে যারা আসেন তারা সাধারণত বেশিরভাগই শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত জীবনের অধিকারী ছিলেন। সন্তান বা স্বজনের কাছ থেকে আঘাত পেয়েই এখানে আসা। জীবনের সমস্ত স্বপ্ন দিয়ে সন্তানদের শিক্ষিত করে তুললেও সেই সন্তানেরাই বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে যান এই আশ্রমে। অবশ্য কারো কারো জন্য ব্যতিক্রম গল্পও আছে।

Advertisement

প্রবীণ নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক রেজাউল করিম। বলেন, এই নিবাসে যারা আসেন, তারা বেশিরভাগই আত্মসম্মান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। উচ্চশিক্ষিত। অনেকের বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। কিন্তু সে বাড়িতে এখন সন্তানের কারণেই ঠাঁই হয় না। সন্তানেরাই রেখে যান এখানে। নতুবা নিজেরাই স্বেচ্ছায় চলে আসেন। আর ফিরে যান মরণেই পরেই।

বলেন, রোজার মাসে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ইফতার পাঠান এখানে। কিন্তু সন্তানেরা আসে না। সত্যিই বিচিত্র এক পৃথিবী।

আশ্রমের প্রিয় মানুষ মিরা চৌধুরী। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পাস করেছেন। শিক্ষকতাও করেছিলেন। স্বামী আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর পরিচালক ছিলেন। একমাত্র ছেলে আমেরিকায় পড়াশোনা করে, সেখানেই ব্যাংকে চাকরি করছেন। স্বামীর মৃত্যুর পরেই বাড়ি, জমি বিক্রি করে চলে এসেছেন এই আশ্রমে। এখন ব্যাংকে রাখা টাকা থেকেই খরচ চলে আশ্রমের।

এদিন বিকেলে লাঠিতে ভর করে বারান্দায় এসে বসেন মিরা চৌধুরী। শরীর আর আগের মতো চলে না। কুশল জানতেই বললেন, রোজার মাসে বেশ ভালো থাকি আমরা। অনেকেই আসেন। ইফতার সামগ্রীও পাঠান। কিন্তু নিজ সন্তান তো আসে না। আমার ছেলে না হয় আমেরিকায় থাকে। পড়াশোনার জন্য আমিই পাঠিয়েছি ওকে।

Advertisement

ছেলেকে দেশে আসতেও বারণ করেছি। কি হবে এদেশে এসে? আমার তো দিন-ই শেষ। কিন্তু যাদের সন্তানেরা এদেশেই প্রতিষ্ঠিত বড় অফিসার, তারা বাবা-মাকে দেখতে আসেন না এখানে। এখন অন্যের সন্তানেরাই খোঁজ নেন আমাদের। সেও তো আনন্দের। তবুও তো স্বাধীন আছি। এখন শুধু আশ্রম আর কবরের দূরত্ব নিয়ে ভাবি।

এএসএস/এমআরএম/এমএস