স্নায়ুযুদ্ধ শেষ। ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্ত হয়ে গেল দুই জার্মানি। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ফিফাও গ্রহণ করল নতুন নীতি। প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আয়োজন করল ১৫তম বিশ্বকাপ আসরের। আবারও নিজ মহাদেশের বাইরে শিরোপা জিতল ব্রাজিল। এবারসহ সর্বোচ্চ চারবার শিরোপা গেল ব্রাজিলের ঘরে। একই সঙ্গে শিরোপা জয়ে ইতালি-জার্মানিকেও পেছনে ফেলে দিলো লাতিন পাওয়ার হাউজটি।
Advertisement
১৯৭০ সালে সর্বশেষ ব্রাজিলকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন গ্রেটেস্ট ফুটবলার পেলে। এরপর কেটে গেলো ২৪টি বছর। সক্রেটিস, জিকোদের মতো বিশ্বসেরা ফুটবলার এসেছেন; কিন্তু শিরোপা এনে দিতে পারেননি সেলেসাওদের। ২৪ বছর পর ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে আবার যেন নিজেদের ফিরে পায় ব্রাজিল। রোমারিও, বেবেতোদের হাত ধরে আবারও বিশ্বকাপ জয় করে নিতে পারলো তারা।
১৯৮৮ সালেই ফিফা যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাগতিক দেশ হিসেবে নির্ধারণ করে। নিজেদের দেশে বড় কোনো লিগ চালু না থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্র। ৯টি শহরে ১৭ জুন থেকে ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ।
১৯৯৪ বিশ্বকাপের চমক ছিল গ্রিস, নাইজেরিয়া এবং সৌদি আরব। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর এবারই প্রথম খেলে রাশিয়া। পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি এক হওয়ার পর এবারই প্রথম দুই জার্মানি মিলে খেলেছে বিশ্বকাপে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য ১৯৯৪ সাল থেকেই আফ্রিকা থেকে নেয়া হয়েছে তিনটি দল। নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন আর মরক্কো একসঙ্গে বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল সেবার।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন করলো এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র। প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল তারা। এর পরেই বিশ্বকাপের আয়োজক হলো যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপের পর এবারই প্রথম রাউন্ড পার হতে পেরেছিল তারা।
তবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ রেকর্ড গড়ে দর্শক উপস্থিতির দিক থেকে। ম্যাচ প্রতি প্রায় ৬৯ হাজার দর্শক উপস্থিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সব মিলিয়ে ছিল ৩৬ লাখেরও বেশি। যে কারণে, ফিফার কাছে অর্থনৈতিকভাবে সফল বিশ্বকাপ ছিল ১৯৯৪ সালেরটাই।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ম্যারাডোনা ১৯৯০ সালেও ছিলেন আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে পৌঁছে দেয়ার অন্যতম কারিগর; কিন্তু ১৯৯৪ বিশ্বকাপে এসে এক ম্যাচ খেলার পরই ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে ফিফা তাকে বিশ্বকাপে আর খেলারই অনুমতি দেয়নি। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে ড্রাগ কেলেঙ্কারির জন্য ম্যারাডোনা নিজের নামের সঙ্গে কলঙ্কের কালি লাগিয়ে দিলেন।
বুলগেরিয়াই এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় চমকটি দেখায়। আগের বিশ্বকাপে যে দলটি একটি ম্যাচও জিততে পারেনি সেই দলটি গ্রুপ পর্বে ৩টি ম্যাচের মধ্যে ২টি জিতে চলে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে মেক্সিকোকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চলে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। কোয়ার্টারে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে চলে যায় সেমিফাইনালে। সেমিতে ইতালির কাছে হেরে বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়ে যায় তাদের। সুইডেনের কাছে হেরে চতুর্থ স্থান অর্জন করে বুলগেরিয়া। ৬টি গোল করে বুলগেরিয়ার রিস্টো স্টয়েসকভ রাশিয়ার ওলেগ সালেঙ্কোর সঙ্গে জেতেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।
Advertisement
বিশ্বকাপ শিরোপা ব্রাজিল জিতলেও বিশ্বকাপের বাইরের একটি ঘটনা এই বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখবে। কলম্বিয়ার দল নিয়ে এমনিতেই সমালোচনা চলছিল বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই। দল নির্বাচন নিয়ে কোচ ফ্রান্সিসকো মাতুরানাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।
কেউ কেউ মনে করেছিলেন কলম্বিয়া দল বাজিকরদের খপ্পরে পড়েছে। বিশ্বকাপে খেলতে এসেও তেমন গুঞ্জনগুলোরই যেন প্রতিধ্বনী তুলল কলম্বিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ডিফেন্ডার আন্দ্রেস এসকোবার নিজের জালে নিজেই বল জড়িয়ে দেন। আত্মঘাতী গোলটি করেই যেন নিজের মৃত্যু পরোয়ানা লিখে ফেলেছিলেন তিনি। বিষযটা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতেও পারেননি তিনি। মাত্র ১০ দিন পর নিজ দেশে ফিরেই মেডেলিনের কাছে একটি বারের পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এসকোবার।
বিশ্বকাপে এবারই প্রথম টাইব্রেকারে নির্ধারিত হয় ফাইনালের ফলাফল। ইতালি আর ব্রাজিল ফাইনালে মুখোমুখি। নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হওয়ার পর আরও ৩০ মিনিট খেলা হলো; কিন্তু কোনো দলই গোল করতে পারল না। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। শুরুতেই শট মিস করেন ব্রাজিলের মারসিও স্যান্তোস। ইতালির ব্রাসেরিও মিস করেন। এরপর চতুর্থ শট মিস করেন ইতালির মাসারো। রবার্তো ব্যাজিও শেষ শটটিও মিস করে ইতালির হারের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন। কোচ আলবার্তো পেরেইরা দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে জিতলেন শিরোপা।
আইএইচএস/এমএস