দেশজুড়ে

৪ প্রতিবন্ধীর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

সমাজের বোঝা নয়, স্বাবলম্বী হয়েই বাঁচতে চায় প্রতিবন্ধীরা। এরই প্রমাণ রেখেছে ফরিদপুরের ক’জন প্রতিবন্ধী মানুষ। সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে বাঁচার তাগিদে পোশাক তৈরির দোকান খুলে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার পথ বেছে নিয়েছেন তারা।

Advertisement

ফরিদপুর শহরের টেপাখোলার বৃন্দাবনের মোড় এলাকায় রাস্তার পাশে একটি দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে চার মাস আগে মেয়েদের পোশাক তৈরির জন্য সূর্যোদয় টেইলার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তারা। উদ্যোক্তাদের সকলেই প্রতিবন্ধী। মূল উদ্যোক্তা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সূর্যোদয় প্রতিবন্ধী সংস্থার সভাপতি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা।

টেইলারের কাটার মাস্টার মিজানুর রহমান, সেলাই মেশিন চালক হেলেনা আক্তার ও রাহেলা বেগম শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং শিক্ষানবিশ কারিগর চায়না আক্তার বাক প্রতিবন্ধী।

প্রতিবন্ধী মিজানুর রহমানের চরভদ্রাসন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের একটি বাজারে টেইলার্সের দোকান ছিল। ওই দোকান ভালো চলতো না। পরে কুদ্দুস মোল্লার অনুপ্রেরণায় প্রতিবন্ধী মিজানুর সেখান থেকে সেলাই মেশিন দুটো নিয়ে শহরে চলে আসেন। মাত্র দুটি পা চালিত সেলাই মেশিন ও একটি পা চালিত ওভার লক মেশিন দিয়েই বর্তমানে সূর্যোদয় টেইলার্সে চলছে পোশাক তৈরির কাজ।

Advertisement

ঈদকে সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। টেইলার্সটিতে এখন চলছে সালোয়ার, কামিজ, থ্রিপিস, ব্লাউজসহ নারীদের বাহারি রঙ ও ডিজাইনের পোশাক তৈরির কাজ। রুগ্ন পা দিয়েই হেলেনা চালিয়ে যাচ্ছেন সেলাই মেশিন। মনের জোর আর স্বাবলম্বী হবার ঐকান্তিক ইচ্ছাকে পুঁজি করেই কর্মযজ্ঞে নেমেছে প্রতিবন্ধী এই মানুষগুলো।

সেলাই মেশিন চালক হেলেনা আক্তার জানান, শৈশবে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচলে অক্ষম হয়ে যান তিনি। তাই একটি পা দিয়েই কষ্ট করে সেলাই মেশিন চালাতে হয় তাকে। স্বামী পরিত্যাক্তা এই নারী আরও জানান, এই কাজের আয় দিয়েই দুটি সন্তান নিয়ে বর্তমানে কোনোরকমে তার সংসার চলছে।

মূল উদ্যোক্তা সূর্যোদয় প্রতিবন্ধী সংস্থার সভাপতি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা বলেন, এক সময় এডিডি নামের একটি সংস্থা প্রতিবন্ধীদের আত্মকর্মসংস্থানে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতো। কিন্তু দুই বছর যাবৎ সংস্থার কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় তাদের মৌখিক পরামর্শ ছাড়া আর কিছু পাচ্ছি না। তবে সমাজসেবা অধিদফতর আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

তিনি আরও জানান, বাঁচার তাগিদে কিছু একটা করার পরিকল্পনা খুঁজতে থাকি। সর্বশেষ আমাদের সংস্থার মিজানুরকে বুঝিয়ে তার দুটি পা চালিত সেলাই মেশিন নিয়ে আসি ফরিদপুর শহরে। আমাদের সঞ্চয়ের ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে মাসে দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় একটি দোকান-ঘর ভাড়া নেই। সেখানেই চার মাস ধরে চলছে আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

Advertisement

শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের পায়ে চালানো সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করার সমস্যার কথা জানিয়ে বিদ্যুৎ চালিত কয়েকটি সেলাই মেশিনের জন্য সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহায়তা চেয়েছেন তিনি।

স্থানীয় আস্থা প্রতিবন্ধী নারী পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় যুব উন্নয়ন পদকপ্রাপ্ত শারীরিক প্রতিবন্ধী নুররাত আক্তার মিনি বলেন, আমি প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষদের স্বাবলম্বী জীবন বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে আসছি। এরই অংশ হিসেবে মিজানুর, হেলেনা আক্তার, রাহেলা বেগম ও চায়না আক্তারকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

প্রশিক্ষণ শেষে এখন তারা নিজেরাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

ফরিদপুর জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এ এস এম আলী আহ্সান জানান, কয়েকজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উদ্যোগে সূর্যোদয় টেইলার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান চলছে শুনে আমি নিজেও অনুপ্রাণিত হয়েছি।

তিনি জানান, সরকার সব সময়ই প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কুদ্দুস মোল্লার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের পাশে থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

তিনি আরও জানান, এ উদ্যোগ প্রতিবন্ধী মানুষদেরকে আরও উদ্দীপ্ত করবে।

জীবন যুদ্ধের অসম প্রতিযোগিতায় নিজেকে মূলধারায় সম্পৃক্ত রাখতে রোজগারের পাশাপাশি অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও স্বাবলম্বী করে তুলতে সেলাই প্রশিক্ষণ দিতে চায় ফরিদপুরের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগী ক’জন। যারা সুস্থ সবল হয়েও কর্মহীন ও উপার্জন বিমুখ এই উদ্যোগ তাদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেণার উৎস।

এমএএস/আরআইপি