খেলাধুলা

ব্রাজিলের দুঃখ : মারাকানাজ্জো, মিনেইরোজ্জো

 

বিশ্বকাপের এবার ২১তম আসর আয়োজন করতে যাচ্ছে রাশিয়া। আগের ২০টি আসরের জয়ী মাত্র ৮টি দেশ। যার মধ্যে ৬টি দেশই নিজেদের মাটি থেকে, অর্থ্যাৎ স্বাগতিক হিসেবে বিশ্বকাপ জয় করেছে। দুটি মাত্র দেশ ছাড়া। দেশ দুটি হচ্ছে ব্রাজিল এবং স্পেন। ১৯৮২ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছিল স্পেন। বিদায় নিয়েছিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই। তাতে হয়তো কোনো ট্র্যাজেডির সংযুক্তি ছিল না।

Advertisement

কিন্তু ব্রাজিল! ফুটবল পাগল দেশটি দু’বার বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে। ১৯৫০ সালের পর ২০১৪ সালে। দু’বারই বড় বড় দুটি ট্র্যাজেডির জন্ম হয়েছে ব্রাজিলে। মারাকানাজ্জো এবং মিনেইরোজ্জো। ব্রাজিল সর্বোচ্চ ৫বার বিশ্বকাপ জয় করেছে। করবে আরও হয়তো। কিন্তু নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করে তারা যে বার বার ট্র্যাজেডির জন্ম দেয়, সেটা ভুলবে কী করে তারা! অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আর ব্রাজিলিয়ানরা বিশ্বকাপেরই আয়োজক হতে চাইবে না।

১৯৩৪ এবং ১৯৩৮- দুটি বিশ্বকাপ পরপর আয়োজন করে ফেললো ইউরোপ। প্রথমটি ইতালি, পরেরটি ফ্রান্সে। পরের বিশ্বকাপের আয়োজক লাতিন থেকেই বেছে নিতে হবে। না হয় লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ বিশ্বকাপে অংশ নেবে না সাফ জানিয়ে দেয়। ফিফা বাধ্য হয়েই লাতিন আমেরিকা থেকে আয়োজক বাছাই করবে। এরই মধ্যে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।

১৯৪২ এবং ১৯৪৬ বিশ্বকাপের আয়েজনই সম্ভব হলো। ১৯৫০ সালে আবারও নব উদ্যমে বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়। আয়োজক লাতিনের দেশ ব্রাজিল। আগের প্রতিটি আসরে হয়তো ফেবারিট ছিল; কিন্তু বিশ্বকাপ জয় সম্ভব হলো না। ১৯৫০ বিশ্বকাপে তাই স্বাগতিক ব্রাজিলই টপ ফেবারিট। বিশ্বকাপ আয়োজনের সঙ্গে জয় করার সবরকম প্রস্তুতিই নিয়ে রাখে ব্রাজিলিয়ানরা।

Advertisement

ওই বিশ্বকাপে নতুন ফরম্যাট করা হয়। অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে চার গ্রুপে ভাগ করে আয়োজন করা হয় রাউন্ড রবিন লিগের। সেই চার গ্রুপ থেকে ১টি করে সেরা চারটিকে তুলে আনা হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। তবে দ্বিতীয় রাউন্ড নকআউট ছিল না। এখানেও ছিল রাউন্ড রবিন লিগ। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে একবার করে মোকাবেলার পর সর্বোচ্চ পয়েন্টধারী দলটিই হবে চ্যাম্পিয়ন।

সে হিসেবে ব্রাজিল সব দিক থেকেই এগিয়ে চলছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে। তবে পয়েণ্ট টেবিলের অবস্থা এমন হয় যে, দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচটিই হয়ে দাঁড়ায় শিরোপা নির্ধারণী। যেখানে উরুগুয়ের মুখোমুখি স্বাগতিক ব্রাজিল। হিসাবটা ছিল খুবই সহজ। ড্র করলেও চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। অন্যদিকে উরুগুয়েকে জিততেই হবে।

স্রেফ ফাইনাল। টান টান উত্তেজনা ব্রাজিজুড়ে। ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে যেন ভেঙে পড়ে পুরো ব্রাজিল। বিশ্বকাপের জন্য রিও ডি জেনিরোয় ব্রাজিল নির্মাণ করেছিল বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ স্টেডিয়াম। রিও ডি জেনিরোর সেই বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামেই ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছিল লিগের শেষ এবং শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি। নিজেদের মাঠে খেলা, ফুটবলপাগল ব্রাজিলিয়ানরা মাঠে না এসে কি থাকতে পারে! তারা ধরেই নিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে ব্রাজিলই।

যে কারণে বিশ্বকাপের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে সর্বাধিক ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯৫৪ জন দর্শক উপস্থিত হয় শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি দেখার জন্য; পুরো মারাকানাকে স্তব্ধ করে দিয়ে সেদিন উরুগুয়ে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় ব্রাজিলকে। ৪৭ মিনিটে আলবিনো ফ্রিয়াকা কার্দোসোর গোলে এগিয়েও গিয়েছিল ব্রাজিল। মারাকানাজুড়ে তখন উৎসবের ঢেউ। বিশ্বকাপ শিরোপা যেন নিশ্চিত।

Advertisement

কিন্তু ৬৬ মিনিটে পুরো মারাকানাকে স্তব্দ করে দিয়ে হুয়ান আলবার্তো সিয়াফিনো সমতায় ফেরান উরুগুয়েকে। এরপর ৭৯ মিনিটে ব্রাজিলিয়ানদের বুকে শেল বিধিয়ে দেন অ্যালডাইস ঘিগিয়া। গোলরক্ষক বারবোসাকে বোকা বানিয়ে ব্রাজিলের জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি। হেরে যায় ব্রাজিল।

প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে বলেছিলেন, ওই সময় যেন পুরো মারাকানায় মৃত্যুপুরির নীরবতা নেমে এসেছিল। অবিশ্বাসভরা দৃষ্টি আর বুকফাটা কষ্ট বিরাজ করছিল পুরো মারাকানায়। ব্রাজিলের এমন হার মেনে নিতে পারেনি ভক্তরা। তৎক্ষণাৎ গ্যালারিতেই আত্মহত্যা করে বসে ৫০-এর বেশি সমর্থক। হার্ট অ্যাটাকেও মৃত্যু হয়েছিল অনেকের।

বেতারে ধারা বিবরণী শুনতে শুনতে ব্রাজিলের হার সহ্য করতে না পেরে ইহলোক ত্যাগ করেন তিন ব্রাজিলিয়ান সমর্থক। মারাকানায় পরাজয় সহ্য করতে না পেরে গ্যালারি থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে ৫০-এরও বেশি সমর্থক। অন্যদিতে মন্টেভিডিওতে অতি আনন্দে তিন উরুগুইয়ান সমর্থকও চির বিদায় নিলেন মাটির পৃথিবী থেকে। নিজেদের ইতিহাসে ব্রাজিলের জন্য এ দিনটি হয়ে রইল একটি কালো দিবস হিসেবে। 'মারাকানাজ্জো' হিসেবে ফুটবল ইতিহাসে পরিচিত ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালের ঘটনা।

মারাকানাজ্জোর ৬৪ বছর পর আবারও বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিল। এবারও নেইমারদের নিয়ে টপ ফেবারিট ব্রাজিল। আগের বছর স্পেনের মত দেশকে হারিয়ে তারা জিতেছিল ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ। পরেরবার লুইস ফেলিপে স্কলারির অধীনে বিশ্বকাপে দারুণ গতিতে এগিয়ে চলছিল নেইমারের ব্রাজিল; কিন্তু সর্বনাশটা ঘটে, কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে। ওই ম্যাচে কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার জুনিগা হাঁটু দিয়ে আঘাত করেন নেইমারের কোমরে। পাঁজরের হাঁড় ভেঙে যায় তার। সোজা তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

সেমিফাইনালে উঠলেও নেইমারের অনুপস্থিতি এবং তার অসুস্থতা পুরো ব্রাজিল দলকে আবেগি করে তোলে। কোনোভাবেই সেই চাপ কাটাতে পারেনি তারা। তারওপর সেমিফাইনালে মুখোমুখি শক্তিশালী জার্মানির। বেলো হরাইজন্তের স্টাডিও মিনেইরোয় জার্মানদের মুখোমুখি হয়ে আরও একটি ট্র্যাজেডির জন্ম দেয় ব্রাজিলিয়ানরা। একে তো নেইমার নেই। তারওপর, কার্ড সমস্যার কারণে ওই ম্যাচ খেলতে পারেননি অধিনায়ক এবং দলের সেরা ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা। পুরো আবেগে জর্জরিত ব্রাজিলকে তাই গুণে গুণে ৭টি গোল দিল জার্মানি। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি হিসেবে লেখা হয়ে গেলো ‘মিনেইরোজ্জো’র নাম।

আইএইচএস/আরআইপি