১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালের পূনরাবৃত্তিই ঘটলো ১৯৯০ বিশ্বকাপে। দুটি আলাদা আলাদা বিশ্বকাপ। কিন্তু মঞ্চ যেন একই। মঞ্চের দুই প্রতিপক্ষও এক। আগের বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। এবারও বিশ্বকাপের ফাইনালে পরস্পর মুখোমুখি এই দুই দেশ। তবে এবার আর দিয়েগো ম্যারাডোনার হাতে উঠলো না সোনালি ট্রফিটা। রোমের এস্টাডিও অলিম্পিকে ১-০ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নিলো পশ্চিম জার্মানি।
Advertisement
ইতালি থেকে ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপ জিতে জার্মানি উঠে এলো ব্রাজিল এবং ইতালির উচ্চতায়। তাদের আগে তিনটি করে বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছে কেবল ইতালি আর ব্রাজিল। ১৯৫৪, ১৯৭৪ সালের পর ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপ জিতলো জার্মানি।
১৯৩০ থেকে শুরু হয়ে ১৯৯০- মাঝে কেটে গেছে ৬০টি বছর। এরই মধ্যে ঘটে গেছে কত ঘটনা! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দুটি ছাড়া একে একে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৩টি বিশ্বকাপের আসর। ১৯৯০ সালে ইতালিতে বসলো বিশ্বকাপের ১৪তম আসর। ১৯৮৪ সালে জুরিখে ফিফার কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে ১১ : ৫ ব্যবধানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় ইতালি। মেক্সিকোর পর ইতালি দ্বিতীয় দেশ, যারা দুটি বিশ্বকাপের আয়োজন করলো। ৬০ বছর পূর্তির বিশ্বকাপ শিরোপা উঠলো পশ্চিম জার্মানির হাতে।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে কম গোল হয়েছে ১৯৯০-এ, যে কারণে এ আসরকে গোলের দিক থেকে সবচেয়ে দরিদ্র বিশ্বকাপ নামেও অভিহিত করা হয়। মাত্র ২.২১ গড়ে ৫২ ম্যাচে গোল হয়েছে মাত্র ১১৫টি। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অংশ নিয়েছিল ১১৬টি দেশ। বাছাই করা হয় ২২টি দলকে। সঙ্গে আয়োজক ইতালি এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা।
Advertisement
রক্ষণাত্মক খেলা আর হার্ড ট্যাকলের জন্য এই বিশ্বকাপে রেফারিদেরও হতে হয়েছিল বেশ কঠোর। ১৬টি লাল কার্ডের ব্যবহারই যার প্রমাণ। এমনকি ফাইনালেও লাল কার্ড দেখে বহিষ্কার হয়েছিলেন আর্জেন্টিনার দুই ফুটবলার। পেদ্রো মনজোন এবং গুস্তাভো দেজোত্তি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে ফাইনালে লাল কার্ড দেখে বহিষ্কার হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম। আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে পশ্চিম জার্মানি তৃতীয় শিরোপা জয় করে নেয়।
আর্জেন্টিনাই প্রথম দল, যারা বিশ্বকাপের ফাইনালে কোনো গোল করতে পারেনি। এর আগের ১৩টি বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করেছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দলই। এই বিশ্বকাপে দলগুলো এত রক্ষণাত্মক খেলেছিল যে, তাদের খেলা দেখে মনে হয়েছে কোনোরকম অতিরিক্ত ৩০ মিনিটসহ ১২০ মিনিট পার করতে পারলেই হলো, এরপর টাইব্রেকারে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখা যাবে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্যন্ত চারটি ম্যাচের ফয়সালা হয়েছে টাইব্রেকারে।
সেমিফাইনালের দুটি ম্যাচই নিষ্পত্তি হয়েছে টাইব্রেকারে। আর্জেন্টিনা-ইতালি এবং জার্মানি-ইংল্যান্ড সেমিফাইনালের দুটি ম্যাচই ১-১ গোলে শেষ হওয়ার পর টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা এবং জার্মানি। এর আগে কোয়ার্টারেও যুগোস্লাভিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কোয়ার্টারে টাইব্রেকারে শট মিস করেছিলেন ম্যারাডোনাও।
১৯৯০ বিশ্বকাপই ছিল বিভক্ত জার্মানির সর্বশেষ বিশ্বকাপ। ১৯৯০ সালেরই শেষের দিকে বার্লিণ দেয়াল ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়ে যায়। ভেঙে যায় সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ব্লক। ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নও। ঠাণ্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ারও আগেরও শেষ বিশ্বকাপ ছিল এটি। সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ব্লকের দেশ যেমন যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লোভাকিয়া- ভেঙে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। এই বিশ্বকাপেই সর্বপ্রথম অংশ নেয় কোস্টারিকা, আয়ারল্যান্ড এবং আরব আমিরাত। ৪০ বছর পর খেলতে আসে যুক্তরাষ্ট্র। আয়ারল্যান্ড কোনো ম্যাচ না জিতেই (টাইব্রেকার ছাড়া) খেলে কোয়ার্টার ফাইনালে।
Advertisement
এই বিশ্বকাপে নতুন দুটি নিয়ম চালু করা হয়। একটি হচ্ছে ব্যাক পাসের নতুন নিয়ম। অন্যটি হচ্ছে, বিজয়ী দলকে এতদিন দেয়া হতো ২টি করে পয়েণ্ট। এই বিশ্বকাপ থেকেই বিজয়ী দলের জন্য বরাদ্ধ করা হয় ৩টি করে পয়েণ্ট। তবে, টিভিতে বিশ্বকাপ দেখার দিক থেকে একটা রেকর্ড গড়ে রয়েছে ১৯৯০ বিশ্বকাপ। পুরো বিশ্বকাপ দেখেছে প্রায় ২৬.৬৯ বিলিয়ন (নন-ইউনিক) দর্শক। ১৯৯০ বিশ্বকাপই ছিল এইচডিটিভিতে দেখানো প্রথম বিশ্বকাপ।
১৯৯০ বিশ্বকাপে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল আফ্রিকান সিংহ ক্যামেরুনের উত্থান। ম্যারাডোনার ক্যারিশমাটিক ফুটবলের কারণে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয় করেছিল আর্জেন্টিনা। হাঁটুর ইনজুরি নিয়ে পরেরবারও ছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল-বিস্ময়; কিন্তু শুরুতেই আফ্রিকান সিংহ ক্যামেরুনের গর্জনে তটস্থ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ১-০ গোলে ক্যামেরুনের কাছে হেরে ১৪তম বিশ্বকাপের যাত্রাটাই মন্থর হয়ে গিয়েছিল ম্যারাডোনার দেশের।
গ্রুপ পর্বে সেরা তৃতীয় দল হয়েই দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে কোনো গোল না করেই ফাইনালে গিয়েছিল ম্যারডোনার দেশ। কোয়ার্টারে যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে জয় পায় আর্জেন্টাইনরা। সেমিফাইনালেও ঘটেছিল একই ঘটনা। ইতালির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করার পর টাইব্রেকারে ৪-৩ ব্যবধানে জয় পায় আর্জেন্টিনা।
ক্যামেরুন শুধু আর্জেন্টিনাকে নয়, হারিয়েছিল রুমানিয়াকেও (২-১ গোলে)। পরের ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৪-০ গোলে হারলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। বরং, আর্জেন্টিনা-রোমানিয়ানে পেছনে ফেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে ক্যামেরুন।
রজার মিলার জোড়া গোলে দ্বিতীয় রাউন্ডেও চমক দেখাল আফ্রিকান সিংহরা। কলম্বিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে চলে গেল কোয়ার্টার ফাইনালে (পরে, ২০০২ সালে সেনেগাল এবং ২০১০ সালে ঘানাও গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে)। কিন্তু সেখানেই তাদের জয়যাত্রা থামিয়ে দিয়েছে ইংল্যান্ড। ২-১ গোলে এগিয়ে থাকার পরও গ্যারি লিনেকারের জোড়া গোলে বিদায় নেয় ক্যামেরুনের।
সেমিফাইনালে ইতালি আর আর্জেন্টিনা ম্যাচে ফরাসি রেফারি মিশেল ভাট্টট খেলা শেষে অতিরিক্ত ৮ মিনিট যোগ করেন অসচেতনভাবেই। কারণ খেলা শেষ হলেও ঘড়ি দেখতেই ভুলে গিয়েছিলেন তিনি।
ফাইনালে দিয়েগো ম্যারাডোনাকে পুরো বোতলবন্দী করে রেখেছিল জার্মানি। তাকে বলতে গেলে খেলতেই দেয়নি তারা। তারওপর তিনি ছিলেন কিছুটা ইনজুরিতে পড়া। এমন এক ফুটবলার যখন নিষ্প্রভ থাকেন, দলের অবস্থা খারাপ হতে বাধ্য। তারওপর ম্রাচের ৬৫ মিনিটে ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানকে ফাউল করার অপরাধে লাল কার্ড দেখেন পেদ্রো মনজোন। বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রথম কোনো লাল কার্ড দেখার ঘটনা সেটি। ৮৫ মিনিটে রুডি ভোলারকে ফাউল করেন আর্জেন্টিনার রবার্তো সেনসিনি। যে কারণে পেনাল্টির বাঁশি বাজান মেক্সিকান রেফারি এদগার্দো কোদেসাল। গোল করেন আন্দ্রেস ব্রেহমে। শেষ দিকে গুস্তাভো দেজোত্তি লাল কার্ড দেখলে ৯ জনের দলে পরিণত হয় আর্জেন্টিনা।
জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার তখন পর্যন্ত একমাত্র ফুটবলার এবং কোচ, যিনি খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে জিতেছেন বিশ্বকাপ শিরোপা। এ বিশ্বকাপে রুমানিয়ার বিরুদ্ধে ক্যামেরুনের ৩৮ বছর ২০ দিন বয়সী রজার মিলা গোল করে সবচেয়ে বেশি বয়সে গোলদাতার খেতাব অর্জন করেন। ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জেতেন ইতালির সালবাতোর এসচিলাচি। টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার হিসেবে গোল্ডেন বলও জেতেন এসচিলাচি। মজার বিষয় হলো, ১৯৯০ বিশ্বকাপের আগে মাত্র একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন সালভাতোর ‘টুটু’ এসচিলাচি। অথচ, বিশ্বকাপে এসেই দুর্দান্ত এক নায়কে পরিণত হলেন তিনি।
আইএইচএস/আরআইপি