মতামত

বাজেট স্রেফ রাজনীতি নয়

আগামী বাজেটের আকার হবে চার লাখ ৬০ হাজার কোটি থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। এবং বোঝা যাচ্ছে যে, এটি বিগত বাজেটের মতোই একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার স্বপ্নপূরণে প্রণীত ও সপ্তম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হতে যাচ্ছে।

Advertisement

একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই বছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকিং খাতে বড় বড় কেলেংকারির মাঝে তিনি বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) গত এপ্রিল মাসে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং খাতের কোনো অভিভাবক নেই। সিপিডি মনে করে, দেশের ব্যাংকিং খাত বিকলাঙ্গে পরিণত হয়েছে।

দেশের অর্থনীতির অভিভাবক হিসেবে তিনি সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতেরও অভিভাবক। তার আমলে একের পর এক কেলেংকারীর দায় অনেকটা তার উপরই বর্তায়। রাজস্ব আদায়ের বড় পরিকল্পনা থাকে প্রতিবছর, আর প্রতি বছরই ব্যর্থ হতে হয় সেই লক্ষ্যপূরণে। আশংকা আছে, যে বছরটি চলে গেলো, সেই অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

একাধিকবার চেষ্টা করেও নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ যেমন ছিল, তেমনি অর্থমন্ত্রী এই ক্ষেত্রে সরকার ও তার দল থেকেও প্রত্যাশামতো সহযোগিতা পাননি। তবুও ভ্যাটকে প্রাধান্য দিয়েই তার রাজস্ব সংগ্রহের পথ ঠিক করেছেন তিনি। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও রাজস্ব বোর্ডের অধীনে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটকেই। ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে।

Advertisement

দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আয়কর। আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আর কাস্টমস ডিউটি বা আমদানী-রপ্তানি শুল্ক থেকে সরকার আয় করতে চায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, ২ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। আর নতুন বাজেটে সরকার মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। যদিও রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস হওয়ার কথা প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর, কিন্তু বাংলাদেশে গত চার পাঁচ বছর ধরেই ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায় হচ্ছে বেশি। সেই বাস্তবতা থেকেই গত দুই বছরে সরকারও ভ্যাট থেকেই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরছে।

আয় ব্যয়ের হিসাব বাদ দিলে, এই বাজেট বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য কতটা সুসংবাদ থাকবে তা দেখতে হবে। প্রতি বছরই বেসরকারি খাত বাজেটকে স্বাগত জানায়, কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন চোখে পড়েনা। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ তিন বছর স্থবিরতা দেখা দেয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি বলে যা দেখছি তা আসলে সরকারি বিনিয়োগের কারণে।

নির্বাচনী বছরের বাজেট হিসেবে এবারের বাজেটকে বলা হচ্ছে ভোটের বাজেট। সাধারণত আমাদের দেশে যে উন্নয়ন হয় তাতে দেখা যায় যে প্রথম ৬-৭ মাস কোনো কাজই হয় না। তাই ডিসেম্বরে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে তার জন্য থাকবে বাকি ৬ মাস। বড় অংকের বাজেট যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এমন বাজেট যেটা বাস্তবায়ন যোগ্য। বড় একটা বাজেট দেওয়া হলো, বিরাট ব্যয় করব বলে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা গেল না, তাহলে তা দেয়ার দরকার কী?

Advertisement

সংশোধিত বাজেটের নামে বাজেট কাটছাট করার যে পদ্ধতি তা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট বানালে কাটছাট কম হয় এবং কাজ কর্মের ভিতর একটা গতিশীলতা ঠিকমতো আসে। সেটা একইসঙ্গে আয় এবং ব্যয়ের বাজেট দুটোর ক্ষেত্রেই।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, দেশে উচ্চ ও উচ্চ শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। সিপিডি বলছে, ২০১৫-১৬ সালে শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত বেকার ছিল মোট বেকারের পৌনে ২৩ শতাংশ- যা সবশেষ অর্থ বছরে ছাড়িয়ে গেছে ২৩ শতাংশের বেশি। এ কারণে দেশে আয়হীন কর্মসংস্থান হচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও কর্মসংস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ।

বাজেটের লক্ষ্য থাকে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সর্বজনীন উন্নয়নের জন্য উঁচু বৃদ্ধির হারের কক্ষপথে পৌঁছনো প্রয়োজন। বাজেটে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়। আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই শিল্পগুলি অতি জরুরি, কারণ এখান থেকেই বহু বাণিজ্যিক উদ্যোগের সূচনা হয়, এ সব ক্ষেত্রে প্রচুর কর্মসংস্থানও হয়। যে সংস্থাগুলি এই ক্ষেত্র থেকে সফল ভাবে পরের ধাপে পৌঁছতে পারবে, অর্থমন্ত্রী তাদের জন্য কিছু কর-বহির্ভূত ছাড় দিবেন বলে আশা করছি। এই ক্ষেত্রে অর্থ সংস্থানের সুযোগ বাড়লে এবং শিল্পমুখী গবেষণায় আরও বিনিয়োগ করা হলে এই ধরনের শিল্পের বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হতে পারে।

অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারের কাজে আসন্ন বাজেটটি কতটা সহায়ক হবে, তার নির্ভর করবে বিনিয়োগ বাড়াতে কতটা উৎসাহ থাকছে তাতে। অবকাঠামোয় সরকারি উদ্যোগের প্রসার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু সেসব কাজে লাগিয়ে উৎপাদন শিল্পে বা সেবাখাতে কি বেসরকারি খাত ঝাঁপিয়ে পড়ছে?

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কিংবা দেশি বিনিয়োগ কোনটিই দৃষ্টি আকর্ষণ করছেনা। বিনিয়োগকারীদের পুরোনো সব সমস্যা রয়েই গেছে, সাথে নতুন করে আলচিত হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট। বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো না হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, মূল কারণ কার্যকর সংস্কারের অভাব। সরকার অবকাঠামো নিয়ে এতকিছু বলছে বা দৃশ্যত করছে, কিন্তু দেশে যোগাযোগসহ অবকাঠামো পরিস্থিতি খুবই খারাপ।বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতিও একটি বড় বাধা। যে কোনো ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়ায় পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। দেশে কর্পোরেট করের হারও উচ্চ।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার হয়নি। বিনিয়োগে ১০টি বাধার ক্ষেত্র হল- ব্যবসা শুরু, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণের প্রাপ্যতা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও অসচ্ছলতা দূরীকরণ। এর কোনোটিতেই সেই অর্থে কোন উন্নতি নেই।

সব বাজেট বক্তৃতারই দু’টো দিক থাকে। একটা অর্থনীতির, অন্যটা রাজনীতির। রাজনীতির কথা প্রচুর থাকে বাজেট বক্তৃতায়। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনেই বাজেটে গরিব, মধ্যবিত্তের জন্য ‘উপহার’দেয়ার চেষ্টাও থাকে, নির্বাচনী বছরে হয়তো আরও বেশি তাকাবে। গ্রাম-গরিবের মন জয় করতে গিয়ে শিল্প ও বিনিয়োগের পথের কাঁটা দূর করতে পারবেন কিনা অর্থমন্ত্রী তা দেখার অপেক্ষায় আছে জাতি। কারণ নতুন চাকরি তৈরি করা দরকার। যে পরিমাণ চাকরি দরকার, তাতে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রতিবারই।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি। এইচআর/জেআইএম