খেলাধুলা

‘আর্জেন্টিনা ফুটবল যেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে’

আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্বকাপের স্বাদ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও যারা বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, তাদেরকে সোনালি ট্রফিটা জয় করার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে পরবর্তী ৪৮ বছর। অবশেষে নিজেদের দেশে, ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে তুলে নেয় আর্জেন্টিনা। জাদুকরি কোচ সিজার লুই মেনোত্তির অধীনে সেবার খেলেছিল একঝাঁক তারকা ফুটবলার। মারিও কেম্পেস থেকে শুরু করে ড্যানিয়েল পাসারেলা, মিগুয়েল অভিয়েদো, রুবেন গ্যালভান, ড্যানিয়েল বার্তোনিরা।

Advertisement

প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই সিজার লুই মেনোত্তি এখন ফুটবল থেকে অনেক বাইরে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তবে বিশ্বকাপ আসলে তো আর বসে থাকতে পারেন না। কিংবা সাংবাদিকরাও তার কাছে ধর্না দেয় তার মূল্যবান বক্তব্য নেয়ার জন্য। তেমনি রয়টার্সের সাংবাদিক হুয়ান আরাঙ্গো মুখোমুখি হয়েছিলেন মেনোত্তির। সেই সাক্ষাৎকারে শুধু মেনোত্তির কথাগুলোই তুলে ধরা হলো এখানে, জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য।

“১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের পর সবাই চলে যায়। কেউই ছিলো না দলে। ব্রিন্দাসি, পারফিউমো, বাবিঙ্গটন, বিয়ানসি- কেউ ছিল না। তারা আমাকে আর্জেন্টিনা দলের দায়িত্ব দিল যখন আমি হুরাকেনের হয়ে ১৯৭৩ সালে শিরোপা জিতলাম তারপর। তারা মূলতঃ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমার সাফল্য দেখেই।

আমাকে যে দল দেওয়া হয়েছিল আমরা সেখান থেকেই শুরু করলাম। আমরা আর্জেন্টিনার একদম ভেতর থেকে খেলোয়াড় নিয়ে জাতীয় দল গঠন করার চেষ্টা করলাম।

Advertisement

কিছু কিংবদন্তিতুল্য ফুটবলার তখন দলে যোগ দেয় যেমন গাল্ভ্যান, ভ্যালেন্সিয়া, পাসারেলা। তারা রিভার প্লেটে খেলতো কিন্তু ক্লাবের হয়ে একাদশে নামার সুযোগ পেতো না। লাকুই খেলতো পারানাতে, বুফালো খেলতো ইউনিয়ন ক্লাবে। দলটা ভালোই ছিল আমাদের।

আমার হাতে তিনজন গোলকিপার ছিল। প্রথম সফরে গাত্তি একাদশে ছিল। দ্বিতীয় সফরে ফিল্লোল ম্যাচের শুরু থেকে ছিল। ফিল্লোল দলে খেলার জন্য মরিয়া ছিল। আমি ফিল্লোলকে বললাম, ‘বর্তমান অবস্থায় তুমি আমার চতুর্থ গোলকিপার’। গাত্তি হঠাৎ করে ইনজুরিতে পড়ে এবং আকস্মিকভাবে চতুর্থ গোলকিপার খুব দ্রুতই দলের একাদশে জায়গা করে নেয়। আমরা যখন ফাইনালে উঠলাম তখন ফাইনালের সূচির দিকে তাকালাম। তারপর একা একাই বলে উঠলাম, ‘এটাই শেষ। আমরা ডাচদের বিপক্ষে ফাইনাল খেলতে যাচ্ছি। তারা সত্যিই অসাধারণ দল।’

ডাচদের রাইনাস মিশেলের মত অধ্যয়নশীল এক কোচ। সে দক্ষিণ আমেরিকায় আসার সময় দলের ভেতর সমন্বয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে গেছে। সে জানতো যে দলটা টেকনিক্যালি অনেক শক্তিশালী, তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করা খুব কষ্টসাধ্য।

ভালো খেলোয়াড় এবং হাই প্রেসে বিশ্বাসী ছিলেন মিশেল। আমার কাছে আরদিলেস ছিল যে প্রত্যেক ম্যাচেই হাঁড়ের ফাটল নিয়ে খেলে গেছে। ফাইনালের ম্যাচের শুরুতে ডাক্তার তাকে ইনজেকশন পুশ করে এমনকি হাফটাইমের সময়েও।

Advertisement

অসভালদো আরদিলেস এমনভাবেই ফাইনালে খেলছিল যে পরবর্তীতে সে অনুশীলনই করতে পারেনি দীর্ঘদিন। ফাইনালে আমরা তাকে অতিরিক্ত সময়েও পরিবর্তন করিনি, যদিও আমাদের করা উচিত ছিল। আর্জেন্টিনা দলের ফিজিও আমাকে বলছিল, ‘আরদিলেসকে তুলে আনো, আমি তাকে আরো একবার ইনজেকশন পুশ করে দিতে চাই।’ আমি এটাতে বেশ রেগে যাই। কারণ সে মাঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছিল; কিন্তু দলের কথা চিন্তা করে আরদিলেসকে তুলে ওমার লারোসাকে নামালাম।

ম্যাচ শেষে আমরা সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। আমরা ড্রেসিং রুমে সবাই মাথা নত করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। সবাই আমাদের কাছে হেরেছে, মাঠে অনেকটা যুদ্ধের মত অবস্থা ছিল। যখন বিষন্নতায় কাতরাচ্ছিলাম, তখন একজন এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন কী করবে?’

আমি তৎক্ষণাৎ চিন্তা করলাম যদি এখানে শক্ত কাঠামো না থাকে তাহলে ভিন্ন ধরনের ফুটবল খেলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, আনন্দে মেতেছি, সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ট্রফিটা এখানেই থাকবে।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম গ্রোন্দোনার কারণেই জাতীয় দল এতোদূর এসেছে। এরপর আমার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে, আমরা জাতীয় দলকে একবারেই ভুলে গেলাম এবং ফিফার মধ্যে ঢুকে ওদের একটি অংশ হয়ে গেলাম। আমরা ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়, ’৯০ সালের বিশ্বকাপ রানার্স আপ হয়েছি, ’৭৯ সালে ম্যারাডোনাদের নিয়ে ইয়ুথ বিশ্বকাপ জয় করেছি।

ফুটবলের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় মানুষের মাঝে বিদ্রোহী মনোভাব সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের মাঝে দেখা দেয় অসন্তোষ। ক্লাবের সংস্কৃতিগুলো অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দিচ্ছে। তারা জাতীয় দলকেও যেভাবে পারে যাদের কাছে পারে বিক্রি করে দিচ্ছে। অনেকটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে তারা।

যখন আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিততে পারছে না তখন তারা ক্লাবের জন্য সবকিছু করছে। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল সাপোর্টার্স গ্রুপ বারাব্রাভাসরা মাঠে খুব বাজেভাবে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তারা ফুটবলের জন্য ক্ষতিকারক। যদি আমরা বিশ্বকাপ জিতিও, তাহলেও এসব কিছুর কোন পরিবর্তন হবে না।

যদি বলি আমরা রাশিয়াতে বিশ্বকাপ জিতবো তাহলেও প্রেসিডেন্ট ফুটবল কাঠামোতে তৈরি করবে না। বিশ্বকাপ অবশ্যই অমূল্য আমাদের সবার জন্য। আমরা সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য খুশি থাকবো; কিন্তু তারপর সেই বাস্তবতাতেই আসতে হবে আমাদের। এখানে ফুটবলের নির্দিষ্ট কোন কাঠামো নেই। খেলা দেখতে আসা অন্য দলের সাপোর্টাররা মাঠে ম্যাচ দেখতে পারেন।

আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছি। যদি আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ যেতেও, এগুলো কিছুর পরিবর্তন হবে না। সবকিছু পরিবর্তন হবে তখনই, যখন একজন নেতা তার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে সামনের দিকে এগুবেন। আপনার তাদেরকে বিশ্বাস করতেই হবে। কারণ সাম্পাওলিরা মাত্র শুরু করলো। সাম্পাওলি খুব সামান্য সময় পেয়েছে। সাম্পাওলি সবকিছুই মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমি জানতে চাই পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার ফুটবলে কী হতে যাচ্ছে।”

আরআর/আইএইচএস/পিআর