টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জনজীবন। ঢল ও জোয়ারের পানিতে বন্দী হয়ে আছে জেলার বেশিরভাগ এলাকা। ডুবে আছে রাস্তা-ঘাট, নদী-নালা, পুকুর ও শত শত একর চিংড়ি ঘের। এতে ভেঙে পড়েছে জেলার অর্থনীতি। ভাঙনের কবলে পড়ায় বেড়িবাঁধ নির্ভর উপজেলা পেকুয়া কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর অনেক এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।উজানে ঢলের পানি, ভাটায় জোয়ারের পানি ত্রাহী অবস্থায় ফেলেছে জেলার লাখ লাখ মানুষকে। তবে এসব বানভাসীকে দুর্ভোগমুক্ত রাখতে সব রকমের তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক প্রেসব্রিফিংয়ে এসব বথ্য জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন।তিনি জানান, দ্বিতীয় দফা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’র প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে জেলার ৩৮ ইউনিয়ন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতির মুখে পড়েছে আরো অন্তত পাঁচটি ইউনিয়ন। তার মতে, পাহাড়ি ঢলের বন্যায় চকরিয়ার আটটি, রামুর ১০টি, পেকুয়ার ছয়টি ও কক্সবাজার সদরের দুটি ও উখিয়ার একটি ইউনিয়ন ক্ষতির মুখে পড়েছে।অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে বেড়ে যাওয়া সামুদ্রিক জলোচছ্বসে কুতুবদিয়ার তিন ইউনিয়ন, মহেশখালীর তিন ইউনিয়ন, টেকনাফের দুটি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও কুতুবদিয়া ও পেকুয়ার আরো বাকি তিন ইউনিয়ন এবং চকরিয়ার তিন ইউনিয়ন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।জেলা প্রশাসকের মতে, এর মধ্যে রামু, কক্সবাজার সদর ও উখিয়া ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় বন্যার সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’র প্রভাবে সাগরের প্রবল জলোচ্ছ্বাসও আঘাত করেছে। এতে এসব এলাকার বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সাগরের পানিতে বেশি ক্ষতি হয়েছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া ও পেকুয়ার অধিকাংশ এলাকা।সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বন্যাকবলিত লোকজনের মাঝে ত্রাণ বিতরণসহ সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩১৪ মেট্রিক টন চাল ও নগদ আট লাখ ৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।এর মধ্যে কক্সবাজারে সদরে ৩৩ মেট্রিক টন চাল ও ৩৫ হাজার টাকা, কক্সবাজার শহরে দুই লাখ টাকা, রামুতে ৬০ মেট্রিক টন চাল ও ৯৫ হাজার টাকা, চকরিয়ায় ১০৫ মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা, পেকুয়ায় ৩৩ মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ৭০ হাজার টাকা, মহেশখালীতে ১৯ মেট্রিক টন চাল ৫০ হাজার টাকা, কুতুবদিয়ায় ২৪ মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ১০ হাজার টাকা এবং উখিয়ায় পাঁচ মেট্রিক টন চাল ও ৩০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।এছাড়া স্ব-স্ব উপজেলা থেকেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে তবে এর সঠিক বিবরণ তিনি এখনো পাননি বলে দাবি করেছেন।ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া আরো ১৮৬ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, এসব চাল ও টাকা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে। ইতোমধ্যে ৫শ` মে.টন চাল ও ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছিল জেলা প্রশাসন।সংবাদ বিফ্রিংয়ে ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ প্রসঙ্গ ছাড়াও বন্যার কারণ ও উত্তরণ নিয়ে আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় কারণ হিসেবে নদী দখল ও ভরাট, দুর্বল বেড়িবাঁধ ও স্লুইচগেটে অপরিকল্পিত রক্ষণাবেক্ষণকে দায়ী করা হয়।এছাড়া দীর্ঘ চার বছর ধরে সাগরের করাল গ্রাসের শিকার শাহপরীর দ্বীপ নিয়ে বিশেষ আলোচনা স্থান পায়। এসব সমস্যা উত্তরণে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের পরামর্শ চান জেলা প্রশাসক।জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এখানকার বিষয় বিশেষভাবে তদারক করছে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বন্যা ও জলোচ্ছাস দুর্গত একটা লোকও যেন না খেয়ে থেকেছে এমন অভিযোগ না আসে। তাই পিরিস্থিতি উত্তরণে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। আরো বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আজ-কালের মধ্যে তা হয়তো পৌছে যাবে।তবে দুর্গত লোকজনকে সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সবার সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যা দুর্গতরা যাতে কোনোভাবেই কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা সবার ঈমানি দায়িত্ব।তার মতে, সব জায়গার খবর পুরোপুরিভাবে নেয়া প্রশাসনের সম্ভব হয় না। এসব কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম ও সাংবাদিক সমাজ। তাদের তথ্য ও সংবাদ দুর্গতি দূর করতে মূখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।আগামী অমানিশার তিথিতেও জলোচ্ছ্বাস বাড়তে পারে উল্লেখ করে এখন থেকে সে সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাগাদা দেন উপস্থিত সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ আর জেলা প্রশাসন করণীয় নির্ধারণ করতে উপজেলা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন এবং টেকসইভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ মেরামতে উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।সায়ীদ আলমগীর/বিএ
Advertisement