খেলাধুলা

১৯ বছর আগে এই দিনে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠেছিল নর্দাম্পটন

৩১ মে, ১৯৯৯। ঠিক ১৯ বছর আগের আজকের এই দিন। লাল-সবুজ পতাকা পত পত করে ওড়ার দিন। বাঙ্গালির ক্রিকেট বিজয়ের কেতন ওড়ানোর দিন। ক্রিকেটের পরাশক্তি, ১৯৯২ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও ১৯৯৯ সালের অন্যতম ফেবারিট, পরে রানার্স আপ, পাকিস্তানকে হারানোর দিন।

Advertisement

বাংলাদেশের সোনালী অতীত, গৌরব, গর্ব আর অহঙ্কারের এক দলিল সেই ম্যাচ। ৯৯‘র বিশ্বকাপে প্রথম বাঘের হুঙ্কার দেখেছিল পাকিস্তানিরা এবং সেটা আজকের এই দিনে ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনে।

টাইগারদের শৌর্য্য আর বিরোচিত নৈপুণ্যের কাছে কুপোকাত হয়েছিল ওয়াসিম আকরাম, সাঈদ আনোয়ার, আফ্রিদি, ইজাজ, ইনজমাম, সেলিম মালিক, আজহার মেহেমুদ, ওয়াকার ইউনুস, মঈন খান, শোয়েব আখতার আর সাকলাইন মোস্তাকের পাকিস্তান।

ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের কথা ভুলি কি করে? আমি সৌভাগ্যবান সেই ম্যাচ দেখেছি। দেখেছি মানে ঘরে বসে টিভিতে নয়, একদম নর্দাম্পটের প্রেসবক্সে বসে কভার করেছি বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচটি।

Advertisement

প্রয়াত রউফুল হাসান (তখন তিনি বাংলাদেশ অবজারভারের স্পোর্টস এডিটর), অজয় দা (সংবাদের ক্রীড়া সম্পাদক), শুভ্র দা (প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র), শহিদুল আজম ভাই (তখন মানবজমিনের ক্রীড়া সম্পাদক, এখন এটিএন নিউজের অন্যতম বার্তা সম্পাদক), অঘোর দা (তখন ভোরের কাগজের ক্রীড়া সম্পাদক, বর্তমানে দীপ্ত টিভির ক্রীড়া বিভাগের প্রধান অঘোর মন্ডল), শহিদ ভাই (তখন দৈনিক ইনকিলাবে ছিলেন, এখন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি’র সহ-সভাপতি) আর আমি নর্দাম্পটনের খোলা প্রেসবক্সে বসে ওই ম্যাচ কভার করেছি।

আমাদের সাথে ক’জন পাকিস্তানি রিপোর্টারও ছিলেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ম্যাচ শুরুর আগে তাদেরকে বলেছি, তোমাদের দল বিশ্বসেরা। অনেক বড় আর নামি-দামি তারকায় ঠাসা। আর আমাদের দল বিশ্বমঞ্চে প্রথম। অনভিজ্ঞ। আমরা পারবো না, তোমরাই জিতবা।

সৃষ্টি কর্তার অপার কৃপা আর আমার তখনকার হাউজ জনকন্ঠ পত্রিকার সৌজন্যে আমিও ছিলাম সেবারের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে এবং বাংলাদেশের সবগুলো ম্যাচই কভার করার সুযোগ হয়েছিল।

আজ বারবার ওই ম্যাচের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সে ম্যাচটিতে খেলা শাহরিয়ার হোসেন, মেহরাব হোসেন অপি, আমিনুল বুলবুল, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আকরাম খারন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট আর মোহাম্মদ রফিকের সম্মিলিত চেষ্টা এবং বিশেষ করে খালেদ মাহমুদ সুজনের দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরমেন্সের দ্যুতিমাখা নৈপুণ্যের কথা।

Advertisement

ওই ম্যাচকে ঘিরে কত ঘটনা! কত স্মৃতি। পাকিস্তান তখন দারুন শক্তিশালী একটি দল। ক্রিকেট বিশ্বের ভয়ঙ্কর পেসজুটি, ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস। সঙ্গে আগুন মাখানো শোয়েব আখতার। তিন ভয়ংকর ও বিশ্ব সেরা ফাস্ট বোলার একসঙ্গে। সাথে ব্যাকআপ পেসার আজহার মেহমুদ। আর ওই সময়ের অন্যতম সেরা অফস্পিনার সাকলাইন মোস্তাকের সাথে লেগস্পিনার শহিদ আফ্রিদির গড়া তীক্ষ্ন ও ধারালো বোলিং। সাঈদ আনোয়ার, আফ্রিদি, ইজাজ, সেলিম মালিক, ইনজামাম ও মঈন খানদের দিয়ে সাজানো বিশ্বমানের ব্যাটিং লাইন আপ।

সেই দলের সাথে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ। টিম মিটিংয়ে সাব্যস্ত হলো, সাধারণ হিসেব নিকেশে আমাদের জেতার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। তাই পরাজয় নিশ্চিত ভেবে ঠিক করা হলো, তাহলে যারা এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে একটি ম্যাচও খেলার সুযোগ পায়নি, তাদের সুযোগ দেয়া। আর সে কারণেই চার-চারটি পরিবর্তন বাংলাদেশ একাদশে। প্রথমবার একাদশে সুযোগ পেলেন নিয়ামুর রশিদ রাহুল। তাতেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশীদার হয়ে গেলেন রাহুল।

‘আরে আমাদের যে বিশ্বমানের বোলিং! বাংলাদেশ তো নস্যি! আমাদের বোলিং তোড় সামলাতে না পেরে নির্ঘাত মুখ থুবড়ে পড়বে।’ নির্ঘাত এমন কিছু ভেবেই টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। চিন্তা ছিল বাংলাদেশকে চট জলদি অলআউট করে যত কম সময়ে সম্ভব ম্যাচ জিতে বিজয়ীরবেশে টিম হোটেলে ফেরা।

কিন্তু টাইগারদের চিন্তা ছিল ভিন্ন। টিম মিটিংয়ে বলা হয়, সবাইকে নির্ভার থাকতে। আমাদের হারানোর কিছু নেই। যা করবো সেটাই ভাল। যদি উজ্জ্বল কিছু করতে পারি, সেটাই হবে আগামী দিনের পাথেয়।

সেটা ভেবেই যাত্রা শুরু। প্রথমেই শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ চমক। ওয়াকার ইউনুসের দুর্দান্ত গতি আর সুইংকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে লেগ মিডল স্টাস্পে পিচ পড়া খানিক ওভার চিড ডেলিভারিকে মিড উইকেট আর মিড অনের ওপর দিয়ে তুলে সীমানার ওপারে পাঠালেন বিদ্যুৎ। তারপর আজহার মেহমুদকেও অনসাইডে তুলে মারা। সাহসী শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের ব্যাট যেন ‘বিদ্যুৎ’ খেলে গেলো বার বার। উইকেটের সামনে ও দুদিকে কিছু আকর্ষণীয় শট খেলে মাঠ গরম করলেন বিদ্যুৎ।

অপর প্রান্তে মেহরাব হোসেন অপি তেমন কিছু করতে না পারলেও উইকেট আগলে ছিলেন। মেহরাব অপি আর শাহরিয়ার বিদ্যুতের উদ্বোধনী জুটি পঞ্চাশ পার হয়ে ৬৯-এ গিয়ে থামলো। ধারাভাষ্যে ইমরান খানের ভারি গলাও খানিক নরম হয়ে গেলো। বার কয়েক বলে উঠলেন, এমন বিশ্বামানের বোলিং শক্তির বিপক্ষে প্রথম উইকেটে পঞ্চাশ পার হয়ে যাওয়া! সহজ কাজ নয়। বাহ, বাংলাদেশের ওপেনাররা সেই কাজটিই করে দেখালো অবলীলায়।

ওই জুটিতেই ড্রেসিং রুম চাঙ্গা হলো। বাকিদের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হলো। মনে হলো, আরে! ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার, আজহার মেহমুদ ও সাকলাইন মোস্তাক, আফ্রিদিদের ভয় কি? তারা তো আর আনপ্লেয়েবল না। সাহস, বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে খেললেই খেলা যায়। মারাও যায়। অপি আর বিদ্যুৎ যখন পেরেছে আমরাও নিশ্চয়ই পারবো।

বিদ্যুতের ৬০ বলে ৩৯ রানের পর আকরাম খান তিন নম্বরে নেমে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আরও কিছু সাহসী ও আক্রমণাত্মক শটস খেলে রানের চাকা সচল করলেন। আকরামের ব্যাট থেকে আসলো ৬৬ বলে ৪২। যার ২৪ রান উঠলো শুধু বাউন্ডারি থেকেই। এরপর আমিনুল ইসলাম (২৬ বলে ১৫), নাঈমুর রহমান দুর্জয় (২০ বলে ১৩) ও মিনহাজুল আবেদিন নান্নু (১৪ বলে ১৪) সেট হয়েও দপ করে নিভে গেলেন।

না হয় স্কোরলাইন বড় হতো আরও। তারপরও দুশো পেরিয়ে ২২৩-এ গিয়ে ঠেকলো। তা সম্ভব হলো খালেদ মাহমুদ সুজনের মারমুখি উইলোবাজিতে (৩৪ বলে ২৭)। উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ পাইলটও ২১ বলে ১৫ রানের একটি কার্যকর ইনিংস খেললেন। আর তাতেই বাংলাদেশের রান গিয়ে দাড়ালো ২২৩-এ।

সাঈদ আনোয়ার-আফ্রিদির মত ভয়ংকর ওপেনার, ইজাজ, ইনজামাম, সেলিম মালিক ও মঈন খানের মত ব্যাটসম্যানে সাজানো পাকিস্তানী ব্যাটিং লাইনআপের জন্য এ আর এমন কি? অল্প কটা রান। ছোট টার্গেট। পাকিস্তানীরা অনায়াসে টপকে যাবে ওই সামান্য পুঁজি। প্রেস বক্সে এমন কথা-বার্তা। টিভি ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠেও তেমন কথা-বার্তা।

কিন্তু ছোট খাট গড়নের খালেদ মাহমুদ সুজন শুরুতেই সে ধারণা ভুল প্রমাণের ইঙ্গিত দিলেন। তার বলে স্কোয়ার লেগে ফ্লিক করতে গিয়ে বোকার মত পয়েন্টে ক্যাচ তুলে বিদায় নিলেন আফ্রিদি (২)। ওয়ান ডাউনে এসে সুবিধা করতে পারেননি ইজাজ আহমেদও (০)। সফিউদ্দীন বাবুর গুডলেন্থ বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে বোল্ড হলেন ইজাজ।

সাঈদ আনোয়ার (৯) হলেন রান আউট। উইকেটের আশপাশে দৌড়াতে যার রাজ্যের দুর্বলতা, সেই ইনজামাম-উল হকের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে মিড উইকেট আর মিড অনের মাঝখানে বল ঠেলে ফিরে যেতে গিয়েও পারেননি সাঈদ আনোয়ার। তিনি ফেরার আগেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলের থ্রো চলে যায় কীপার খালেদ মাসুদ পাইলটের গ্লাভসে।

এরপর খালেদ মাহমুদ সুজনের খানিক নিচু হয়ে ভিতরে আসা বলকে পুল করতে গিয়ে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে বিদায় নিলেন ইনজামাম-উল হকও (৭)। ২৯ রানে প্রথম চারজন, আর ৪২ রানে ইনিংসের প্রথম অর্ধেক শেষ।

তখনই জয়ের সম্ভাবনার সূর্য্য উঁকি দিতে শুরু করে। অনেক সংকট ও বিপদে পাকিস্তানের ‘ত্রানকর্তা’ বলে যার পরিচিতি বিশ্বজোড়া, সেই সেলিম মালিকও সুজনের ইনকাটারে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ালেন। অফস্টাম্পের ঠিক বাইরে থেকে ভিতরে আসা বল সেলিম মালিকের পায়ে গিয়ে লাগলো। সমস্বরে আবেদন। হাউ ওয়াজ দ্যাট...। অজি আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার আঙ্গুল তুলে জানিয়ে দিলেন আউট।

পাকিস্তানিদের মুখ চুপসে গেলো। সংকটে, বিপদে যারা ‘ত্রাতা’ তারা একেকজন সাজঘরে। ওদিকে টাইগররা মাঠে দুর্বার। ফিল্ডিংয়ে সবাই যেন হরিণ চপল। চিতাসম ক্ষিপ্র। টাইট বোলিং। কোনরকম বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় না গিয়ে সব বোলার যত সম্ভব ওপরে উইকেট সোজা বোলিংয়ে মনোযোগি। আর ফিল্ডিং ব্যাকআপ দুর্দান্ত। মিস ফিল্ডিংয়ের বালাই নেই। এক পিকআপে বল ধরা আর মুহূর্তে থ্রো।

পাকিস্তানিদের তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা! হালে পানি পাচ্ছিলেন না। একমাত্র বাঁ-হাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের হাত থেকে ওয়াসিম আকরামের রিটার্ন ক্যাচটি ছাড়া কেউ ক্যাচ ড্রপ করেননি। আর ফিল্ডারদের ক্ষিপ্রতা ও নিখুঁত থ্রো’তে রানআউট তিন পাকিস্তানি, সাঈদ আনোয়ার, আজহার মেহমুদ আর সাকলাইন মোস্তাক।

তারপর আজহার মেহমুদ (২৯), ওয়াসিম আকরাম (২৯), মঈন খান (১৮) ও সাকলাইন মোশতাক (২১) প্রাণপন চেষ্টা করেও টাইগারদের উজ্জীবিত এবং প্রত্যয়ী বোলিং-ফিল্ডিংয়ের সামনে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। ওয়াসিম আকরাম আর আজহার মেহমুদের ৫৫ রানের জুটি ভাঙ্গেন অধিনায়ক বুলবুল। নান্নুর বলে মিড উইকেটে ঠেলেই দৌড় শুরু করেন ওয়াসিম। ডান দিকে শরীর মাটিতে ফেলে অসামান্য ক্ষীপ্রতায় বল ধরে কিপারের গ্লাভসে দিয়ে দেন বুলবুল। বিপরীত দিক থেকে আজহার মেহমুদ ক্রিজে ফেরার আগেই পাইলট বেলস তুলে নেন।

অন্যদিকে পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামকে হতাশায় পোড়ান নান্নু। তার স্লো মিডিয়াম বলে মিড উইকেটর ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে চেয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম। বল অনেকটা উুঁচু হয়ে বাতাসে ভেসে গিয়ে জমা পড়লো শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের হাতে। অনেকটা সময় পেয়ে, বলের ফ্লাইট দেখে ও বুঝে ডিপ মিড উইকেট সীমানার এক গজ সামনে দাঁড়িয়ে তা তালুবন্ধি করলেন বিদ্যুৎ। মঈন খানের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ভাঙ্গলো অফস্পিনার নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বলে। ডিপ কভারে মেহরাব অপির হাতে ধরা পড়েন মঈন খান।

একদম শেষ দিকে ঘটলো এক নাটকীয় ঘটনা। নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বলে কভার ও এক্সট্রা কভারের মাঝখানে ঠেলে প্রান্ত বদলের চেষ্টা করলেন শোয়েব আখতার। দারুণ ক্ষীপ্রতায় বল ধরে কভার থেকে অসধারণ থ্রো করলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। নন স্ট্রাইকে থাকা সাকলাইন মোস্তাক ছুটে আসার আগে পাইলট উইকেট ভাঙ্গলেন।

খালি চোখেই ধরা পড়লো রান আউট। তারপরও ফিল্ড আম্পায়ারদ্বয় নিশ্চিত হবার জন্য থার্ড আম্পায়ারের স্মরণাপন্ন হলেন। ওদিকে ফিল্ডারদের আনন্দ-উল্লাস দেখে মাঠের চারিদিকে জয়ের অদম্য বাসনায় উন্মুখ হয়ে থাকা হাজার হাজার বাঙ্গালি ভাবলেন, প্রিয় দল জিতে গেছে। তারা জয়ের আনন্দেই আবেগতাড়িৎ হয়ে গ্যালারি থেকে দৌড়ে মাঠের ভিতর ঢুকে পড়লেন।

গোটা নর্দাম্পটন আউটফিল্ডে মিনিট খানেকের মধ্যে হাজারো বাঙ্গালির সমাবেশ। বাঙ্গালিদের মাঠে ঢোকা আর প্রিয় দলের ক্রিকেটারদের সাথে বিজয় আনন্দ শেয়ার করা থেকে বিরত রাখতে, তাদের নিবৃত্ত করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো ইংলিশ পুলিশ। ধারভাষ্যকাররা বারবার বলতে লাগলেন, ‘পুলিশ হেল্পলেস। টোটালি হেল্পলেস।’ বাংলাদেশ... বাংলাদেশ... ধ্বনিতে কেঁপে উঠছিল তখন নর্দাম্পটনের আকাশ বাতাস।

বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থনে যারা সারাদিন জয় বাংলা আর ‘বাংলাদেশ.. বাংলাদেশ...’ ধ্বনিতে মাঠ গরম করে রেখেছিলেন, সেই সমর্থকদের মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর থার্ড আম্পায়ারের টিভি রিপ্লেতে পরিষ্কার হলো, হ্যাঁ ওটা আউট। সাকলাইন মোস্তাকের ব্যাট পপিং ক্রিজের কয়েক ইঞ্চি দুরে থাকতেই পাইলট বেলস তুলে নিয়েছেন। তার মানে আউট।

আর এরই সাথে ধরা দিল ঐতিহাসিক বিজয়। মুহূর্তের মধ্যে নর্দাম্পটনের মাঠ পরিণত হলো বাঙ্গালির বিজয় উল্লাসের কেন্দ্রবিন্দুতে। ‘জয় বাংলা..., জয় বাংলা...’- স্লোগানে মুখর পুরো স্টেডিয়াম। যেন এখখণ্ড বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের পর আবার জয় বাংলা... স্লোগান শুনে প্রমাদ গুণলো পাকিস্তানি ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ ও প্রবাসী সমর্থকরা।

অন্তত চার পাঁচ হাজার প্রবাসি বাঙ্গালির জয়োল্লাসে আকাশ-বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠলো নর্দাম্পটনে। তাদের আনন্দ দেখে কে? এ যেন রাজ্য জয়ের উৎসব, উল্লাস। আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যেও অন্যরকম পুলক, রোমাঞ্চ। আমরাও উদ্বেলিত হয়ে উঠলাম।

এখনো মনে আছে, শুভ্র দা (উৎপল শুভ্র), আজম ভাই ( শহিদুল আজম), অঘোর দা (অঘোর মন্ডল), শহীদ ভাই আর আমি আনন্দে দিশেহারা। খানিক্ষণ কেমন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিলো, একি জাদু, না মায়া? নাকি স্বপ্ন- পরক্ষণেই মনে হলো, না ওসব কেন হবে? একদম ঘঁষা বাস্তব। আমরা জিতে গেছি। পাকিস্তানের অত্যন্ত শক্তিশালী দলকে হারিয়ে দিয়েছি। তাও ছোট-খাট ব্যবধানে নয়। ৬২ রানের বিশাল ব্যবধানে।

আমদের মাঠে ঢোকার অনুমতি ছিল না। আমরা একটা করিডোরের মত জায়গায় এসে বাঙ্গালির বিজয় উৎসব দেখলাম। নিজেরাও উচ্ছাস-উল্লাস করলাম। ছবিও তোলা হলো। সেদিনের স্মৃতি এখনো মনের আয়নায় জ্বল জ্বল করছে।

১৯ বছর আগে দূর্বল, ভাঙ্গাচোরা অবকাঠামো আর সীমিত সুযোগ সুবিধা নিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া। শুরুতে যা ছিল ‘উৎসব আমেজে’- ভাবটা এমন- প্রথমবার বিশ্বকাপের মহামঞ্চে। এসেছি। দেখবো, খেলবো এবং উপভোগ করবো। তারপরও যেমন ‘গাইতে গাইতে গায়েন আর বাজাতে বাজাতে বায়েন’- ঠিক তেমনি কটা ম্যাচ খেলার পর ধীরে ধীরে নিজেদের খুঁজে পাওয়া। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা।

সর্বশেষ পাকিস্তানের বিপক্ষেই জ্বলে ওঠা। আমিনুল বুলবুল, আকরাম খান, শাহরিয়ার বিদ্যুৎ, মেহরাব হোসেন অপি, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, খালেদ মাহমুদ সুজন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাসুদ পাইলট, শফিউদ্দীন বাবু আর নিয়ামুর রশিদ রাহুলরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথমবার আসলেও আমরাও পারি। নিজেদের দিনে রাঘব বোয়াল শিকার করার সামর্থ্য আছে আমাদেরও।

সেই পথে হেঁটে আজ মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মোস্তাফিজরা এখন আরও এগিয়ে। আরও ওপরে। টাইগাররা এগিয়ে যাক বুক চিতিয়ে, বীরের মত। আজকের দিনে সেটাই প্রত্যাশা।

এআরবি/আইএইচএস/পিআর