খেলাধুলা

১৯৮৬ : ম্যারাডোনাময় এক বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ এর আগেও অনেক বড় বড় তারকার জন্ম দিয়েছিল। হয়তো আরও বড় তারকারও জন্ম দেবে; কিন্তু ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা যা দেখিয়েছেন বিশ্বকে, সেটা বিস্ময়কর বললে কমই বলা হবে। একক কৃতিত্ব আর নৈপুণ্য দিয়ে একটি দেশকে কেউ বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন, সেটা দেখালেন তিনি।

Advertisement

যদিও, ১৯৬২ বিশ্বকাপে তেমন পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন ব্রাজিলের গ্যারিঞ্চা। কিন্তু ম্যারাডোনা এসে একক পারফরম্যান্সে যোগ করেন ভিন্ন মাত্রা। যে কারণে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি এঁটে গেলো তার নামের পাশে। ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে ত্রয়োদশতম বিশ্বকাপের শিরোপা দ্বিতীয়বারেরমত জিতে নিল আর্জেন্টিনা। শিরোপা আর্জেন্টিনার হলেও বিশ্বকাপটা হয়ে রইল পুরো ম্যারাডোনাময়।

বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হয়েছে মেক্সিকোয়। তবে, মেক্সিকো নয়, ১৯৭৪ সালেই কলম্বিয়াকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্ধারণ করে ফিফা। আগের আসর ইউরোপে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, ওই আসরের আয়োজক নির্বাচন করতে হবে ইউরোপের বাইরে। এমন নিয়মের কারণে, কোনো ইউরোপিয় দেশ আবেদনই করার সযুযোগ পায়নি, সেবার। এ কারণেই লাতিনের দেশ কলম্বিয়াকে বেছে নেয়া হয় বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য।

কিন্তু চরম আর্থিক দুর্দশার কারণে কলম্বিয়া বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় ১৯৮২ সালের নভেম্বরে। অগত্যা ১৯৮৩ সালে ফিফা মেক্সিকোকেই আবার পরের বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে নির্ধারণ করে। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা, ১৯৮২ সালে স্পেনের পর ১৯৮৬ মেক্সিকো- টানা তিনটি বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে যায় স্প্যানিশ ভাষা-ভাষির দেশ।

Advertisement

কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র ৮ মাস আগে ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো মেক্সিকো। ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। ভূমিকম্পের কারণে মেক্সিকোতে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। কিন্তু যে স্টেডিয়ামগুলোতে খেলা হওয়ার কথা সেগুলোতে ভূমিকম্প কোনো আঁচড় লাগাতে পারেনি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত মেক্সিকোর ওপরই আস্থা রাখল ফিফা।

কানাডা, ডেনমার্ক এবং ইরাক ১৯৮৬ বিশ্বকাপে প্রথম খেলার সুযোগ পায়। ১৯৫৪ সালের পর প্রথম খেলার সুযোগ পায় দক্ষিণ কোরিয়া। ১৯৮৫ সালের পর প্রথম বিশ্বকাপে নাম লেখাতে সক্ষম হয় প্যারাগুয়ে। ১৯৬৬ সালের পর পর্তুগালকেও দেখা গেলো এই বিশ্বকাপে। আর সেবারই ছিল হাঙ্গেরির সর্বশেষ বিশ্বকাপ।

১৯৮২ সালে বিশ্বকাপে যে ফরম্যাট প্রবর্তন করা হয়, সেটা পাল্টে ফেলা হয় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে এসে। ’৮২’র মতই ২৪ দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে রবিন লিগের যে নিয়ম ছিল সেটা পাল্টে সরাসরি নকআউটের আয়োজন করা হয়। সে ক্ষেত্রে ২৪ দলকে ভাগ করা হয় ৬ গ্রুপে। প্রতি গ্রুপ থেকে সেরা দুটি করে ১২টি দলকে সরাসরি তোলা হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। এছাড়া বাকি ১২ দলের মধ্যে তৃতীয় স্থানের দলগুলোকে নিয়ে গোলের ভিত্তিতে পরবর্তী সেরা চারটি দলকেও তোলা হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। মোট ১৬ দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় রাউন্ডের নকআউট পর্ব।

ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত জাদুই নয়, আরও কয়েকটি কারণে ১৯৮৬ বিশ্বকাপটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে ফুটবলভক্তদের কাছে। এ বিশ্বকাপে খেলেছেন ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি, ব্রাজিলের সক্রেটিস, ক্যারেকা, জিকো, ইতালির পাওলো রোসিদের মত বিশ্বখ্যাত ফুটবলাররা। কিন্তু শেষ হাসি ঠিকই হেসেছেন ম্যারাডোনা।

Advertisement

১৯৭৮ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ছিলেন ১৭ বছরের যুবক। কোচ সিজার লুই মেনোত্তির দলে জায়গাই পাননি। কোচের বক্তব্য, তুমুল সম্ভাবনাময়ী ম্যারাডোনা; কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলের চাপ নেয়ার মত মানসিক শক্তি গড়ে ওঠেনি তার। ১৯৮২ বিশ্বকাপে খেলেছেন; কিন্তু সদ্য বার্সেলোনায় যোগ দেওয়া ম্যারাডোনা একেবারেই ফ্লপ ওই বিশ্বকাপে।

চার বছর পর একই ম্যারাডোনাকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে দেখা যাবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি কেউ। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই ম্যারাডোনা করেন তার বিশ্বখ্যাত দুটি গোল। ‘হ্যান্ডস অব গড’ এবং ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ আসলো এই ম্যাচ থেকেই। তার জোড়া গোলেই ইংলিশদের হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা তার সেই দুটি গোলই ম্যারাডোনাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। প্রথম গোলটি ছিল বিতর্কিত। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুর পরপরই, ৫১ মিনিটে ইংল্যান্ডের জালে হেড করে বল জড়ান ম্যারাডোনা। ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে ফাঁকি দিয়ে তার মাথার ওপর দিয়েই হেড করে বলটা জালে ফেলেন এই আর্জেন্টাইন। তখন সুক্ষাতিসুক্ষভাবে টিভি রিপ্লে দেখা যেতো না। আজকের দিনের মতো ভিডিও টেকনোলজির তো চিন্তাই কারো মাথায় আসার কথা নয়।

কিন্তু ম্যাচ শেষে ম্যারাডোনা নিজেই স্বীকার করেন, ওই হেডটির সঙ্গে হাতও উঠেছিল। রেফারি, লাইন্সম্যান এবং উপস্থিত দর্শক কেউ বুঝতে পারেননি আসলে হাত দিয়ে গোল করেছেন ম্যারাডোনা। তিনি নিজে বলেন, ‘গোলটিতে মাথার সঙ্গে ঈশ্বরের হাতও উঠে এসেছিল।’ এ কারণেই এটি ‘দ্য হ্যান্ড অব গড’ নামে পরিচিত।

তবে দ্বিতীয় গোলটি ছিল সত্যিই অসাধারণ। পাঁচজন ইংলিশ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যে গোলটি করেন ম্যারাডোনা, তা ২০০২ সালে ফিফা কর্তৃক নির্বাচিত হয় ‘দ্য গোল অব সেঞ্চুরি’ নামে। সেমিফাইনালেও ২ গোল করে বেলজিয়ামকে একাই হারিয়ে দেন তিনি।

ফাইনালে গোল করতে না পারলেও পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা। ব্রাউন, ভালদানো এবং বুরিসাগা আর্জেন্টিনার হয়ে গোল তিনটি করেন। জার্মানির হয়ে গোল করেন কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে এবং রুডি ভোলার। ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতলেও অসাধারণ খেলার জন্য গোল্ডেন বল জেতেন ম্যারাডোনা। টুর্নামেন্টে মোট ৫টি গোল করেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। সঙ্গে ৫টি অ্যাসিস্টও করেন তিনি।

বুলগেরিয়া আর উরুগুয়ে গ্রুপ পর্বে কোনো ম্যাচ না জিতেই দ্বিতীয় রাউন্ডে স্থান করে নেয়। ১৯৮২ সালেও গ্রুপ পর্বে কোনো ম্যাচ না জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গিয়েছিল ইতালি এবং শেষ পর্যন্ত তারা হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন। এ ক্ষেত্রে বুলগেরিয়া আর উরুগুয়ে পিছিয়ে। তারা বিদায় নেয় দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই।

ফ্রান্স আর ব্রাজিলের কোয়ার্টার ফাইনালটির কারণেও ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবল দর্শকদের মনে থাকবে অনেকদিন। কোয়ার্টারে মুখোমুখি হয় ফ্রান্স এবং ব্রাজিল। ১৭ মিনিটে ক্যারেকার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিলিয়ানরা; কিন্তু প্লাতিনি ৪০ মিনিটে সমতায় ফেরান ফ্রান্সকে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দারুণ একটি সুযোগ মেলে ব্রাজিলের সামনে। ফ্রান্স গোলরক্ষক জোয়েল বাট পেনাল্টি বক্সে ফাউল করেন ব্রাঙ্কোকে; কিন্তু জিকোর পেনাল্টি শট ফিরিয়ে দিয়ে ফাউল করার প্রায়শ্চিত্ত করেন জোয়েল বাট। অতিরিক্ত সময়ের পর টাইব্রেকারের শুরুতেই শট মিস করেন সক্রেটিস। ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনিও শট মিস করেন। শেষ মুহূর্তে এসে ব্রাজিলের হুলিও সিজারের শট মিসের মধ্য দিয়ে ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ফ্রান্স।

আইএইচএস/এমএস